ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং টেকসই উন্নয়নে মাতৃভাষার গুরুত্ব :

টিবিটি ডেস্ক
এ্যানা সাইমুম রীমা
প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৪ এএম
এ্যানা সাইমুম রীমা

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক শহীদ ও মাতৃভাষা দিবস। এই দিন বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবময় ও অবিস্মরণীয় দিন। ৫২র ভাষা আন্দোলন কেন্দ্র করেই বাঙালি জাতি পেয়েছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।

ব্রিটিশ নাগরিক ন্যাথানিয়েল ব্রাথি হেডলেটই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ১৭৭৮ সালে, "'এ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ'' নামে একটি বাংলা বইয়ে তিনি প্রথম ফার্সি ভাষার পাশাপাশি সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার দাবি করেন।তার প্রথম সেই উচ্চারণের বিজ একদিন রুপ নিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ তবে ১৯৪৮ সাল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সফল বিস্ফোরণ।১৯৪৮ সালে মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে  জিন্নাহ বলেন- That State language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. সেদিন ছাত্ররা দাঁড়িয়ে একসাথে জিন্নাহর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান ‘না, না’ বলে। 

জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী ভাষানের সূত্রধরে ১৯৫২ সালে রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের রুপ নেয়।তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অস্বীকৃতি করায় এবং পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  ছাত্র-ছাত্রী ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন।সাধারণ জনগণসহ ঢাকার  বাহিরেও বিক্ষোভে ফেটে পরে।প্রতিবাদে জ্বলে উঠে বিক্ষুব্ধ বাঙালি। তারা ১৪৪ ধারা  ভঙ্গ করে মিছিল শুরু করে।মিছিলে অতর্কিত পুলিশের গুলিতে সেদিন রফিক,সফিক, বরকত, সালাম,জব্বারসহ নাম না জানা অনেকেই শহীদ হন।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একটি প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ভাষা শহীদদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে স্মরণ করে প্রতি বছর বাঙালি জাতি ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে।২০০০সাল থেকে ভাষা শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা  দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলিতে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে।

ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাদের  আত্মত্যাগকে স্মরণ করে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য প্রতি বছর বাঙালি জাতি ২১ ফেব্রুয়ারি "ভাষা শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন" করে আসছে।

নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে অনুপ্রবেশ ঘটলে সে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

একটি জাতির টেকসই সমাজ গড়ে তুলতে নিজস্ব  সংস্কৃতিক ও ভাষা ধারণ করা আবশ্যক। ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক  ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে প্রথম সোপান। একটি দেশের  সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে গেলে ধীরে ধীরে হারাতে বসে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য কৃষ্টি ও মূল্যবোধ।

চলছে সংস্কৃতির আগ্রাসন।অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ধারাটিকে ক্ষীণ করে ফেলছে, যা মানব সমাজ অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

মানব মনের উৎকৃষ্ট সাধন ও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা করার  জন্য সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন ও ব্যবহারটা বাধ্যতামূলক করা দরকার।আমাদের পাঠ্যপস্তুুক থেকে শুরু করে অফিসিয়াল কার্যক্রমের সব পর্যায়।মাতৃভাষায় পাঠ্য ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভাষায় পাঠ্য বোধগম্য সহজ ও সাবলীল হতে পারেনা।পৃথিবীর বুকে যত উন্নত দেশ আছে তারা স্ব ভাষায় পড়াশোনা করে আজ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে।

তাছাড়া দুঃখজনক হলেও আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ফেলছি যেটা আমি -আপনি অহরহ সবাই করে থাকি।এটায় আমারা এখন আমাদের প্রাতিহ্যক জীবনের কথা-বার্তা, লেখায় অভস্ত্য হয়ে পরছি।না জানি শুদ্ধ বাংলা না ইংলিশ, বাংলিশ একটা অবস্থা। 

এক সময় ফার্সি ভাষায় আরবি ভাষার সংমিশ্রণ ঘটে পারস্যর ভাষা ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি হারাতে বসছিল।এটা উপলব্ধি করে গজনীর রাজা সুলতান মাহমুদ তাদের নিজস্ব হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করতে মহাকবি ফেরদৌসকে নিয়োজিত করছিল "শাহনামা" রচনা করার জন্য। শাহনামা রচনার মাধ্যমে পারস্যরা আবার পেয়েছিল তাদের নিজস্ব গৌরব,ঐতিহাস ও ঐতিহ্য । মৃত্যুপ্রায় ভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষায়ও সক্ষম হয়েছিল। 

অত্যন্ত দুঃখজনক আমাদের সরকারি পর্যায় টেকসই কোন উদ্যগ নেই বললেই চলে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য। 

বায়ান্নর চেতনার পথ ধরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। অমর ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সেইসব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা যাদের জীবন বিসর্জনে আজ আমরা পেয়েছি আমাদের মায়ের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা। আমাদের প্রাণের বর্ণমালা ক,খ,গ,ঘ।