সংকটে চা জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি
বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ‘খাড়িয়া’, যাদের আদি নিবাস ভারতের ছোট নাগপুর, রোহতাসগড় ও অযোধ্যার পাহাড়ি অঞ্চল। ব্রিটিশ শাসনামলে তারা চা শ্রমিক হিসেবে সিলেটে আসে। ধীরে ধীরে স্থায়ী বসত গড়ে তোলে। এদের অধিকাংশই শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। খাড়িয়াদের ভাষার নামও ‘খাড়িয়া’।
বর্তমানে এ ভাষায় কথা বলতে পারেন কেবল দুই বৃদ্ধা ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। তাদের মৃত্যু হলে খাড়িয়া ভাষারও মৃত্যু ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা ও একটি সংস্কৃতি।
দেশের চা বাগানগুলোয় বসবাসরত চা জনগোষ্ঠীর প্রায় প্রতিটির ভাষা ও সংস্কৃতিই খাড়িয়ার মতো আজ সংকটে। দরিদ্রতা, অসচেতনতা এবং বিভিন্ন চা বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের কারণে আত্মপরিচয় হারাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এসব মানুষ। অধিকাংশেরই আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচার থাকলেও তা এখন ভুলতে বসেছে বর্তমান প্রজন্ম। তাদের পরিচয় এখন কেবলই যেন ‘চা শ্রমিক’।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের ১৬৮টি চা বাগানের মধ্যে ৯০টিরই অবস্থান মৌলভীবাজারে। এসব বাগানে ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, মাহালি, সবর, পাসি, রবিদাস, হাজরা, নায়েক, বাউরি, তেলেগু, তাঁতি, কৈরী, দেশওয়ারা, অলমিক, মোদি, তেলি, বর্মা, কানু, পানিকা, খাড়িয়া, কুর্মী, চাষা, পাত্র, মোদক, মাঝি, রাজবংশী, বাড়াইক, ভূমিজসহ ৯৪ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এদের মধ্যে একসময় অন্তত ৩০টি নিজস্ব ভাষা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে কোনো রকমে ঠিকে আছে ১৫টির মতো।
বিপন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে একটি খাড়িয়া। দুই বোন ভেরোনিকা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটার মুখেই কেবল ভাষাটি বাংলাদেশে ঠিকে আছে। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া বস্তিতে। তাদের সঙ্গে কথা হলে ভেরোনিকা কেরকেটা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা দুই বোন ছাড়া দেশে আর কেউ এ ভাষায় কথা বলতে পারে না।
দুঃখ হয় নিজের ভাষায় কথা বলার লোক পাই না বলে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভাষাটি শেখানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তারা শিখতে আগ্রহী না। ঘরের বাইরে গেলেই অন্য ভাষায় কথা বলতে হয়, নিজেদের মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ নেই।’
খাড়িয়া ভাষা রক্ষার উদ্যোক্তা পিউস নানোয়ার। তার দেয়া তথ্যমতে, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের কয়েকটি চা বাগানে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর বসবাস। সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় এদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ২০২০ সালে এক জরিপে দেশে এ জনগোষ্ঠীর ৫ হাজার ৭০০ জনের তালিকা করা হয়। অনুসন্ধানে ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম মিশ্র বাংলায় কথা বলে।
পিউস নানোয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে ২০১৭ সালে আমরা নিজেদের উদ্যোগে “বীর তেলেঙ্গা খাড়িয়া ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার” নামের খাড়িয়া ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র খুলেছিলাম, কিন্তু সফলতা পাইনি। শিক্ষক ও খাড়িয়া ভাষার বইপত্র না থাকায় পারিনি। এমনকি দেশে এ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকায় আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।’
অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই পিউস নানোয়ার বলেন, ‘চা জনগোষ্ঠীর আলাদা ও নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি থাকলেও এখনো আমরা সবাই স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। বৈচিত্র্যে ভরা বাংলাদেশ বলি, কিন্তু আড়ালে যে অনেক জনজাতির ভাষা-সংস্কৃতি শেষ হয়ে যাচ্ছে সে খবর কে রাখে?’
চা শ্রমিকরা জানান, দেশের চা বাগানগুলোর অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাংলা, সাদ্রি বাংলা, ভুজপুরী, দেশোয়ালী ভাষার মিশ্রণে কথা বলে। এর ফলে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে চা অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত ভাষা ও সংস্কৃতি, যেটা এখন চা শ্রমিকদের ভাষা ও সংস্কৃতি হিসেবেই পরিচিত পাচ্ছে।
কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা বাগানের বাসিন্দা মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর মানুষ বয়ো মুণ্ডা। তিনি জানান, তাদের ওই বাগানে হাতে গোনা কয়েকটি মুণ্ডা পরিবার রয়েছে। ফলে তিনি নিজেদের ভাষা জানলেও ব্যবহারের সুযোগ নেই। কেননা বাগানে অন্য জনজাতির সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হয়, তাই কথা বলতে হয় মিশ্র ভাষায়। তাদের নতুন প্রজন্মও নিজেদের ভাষা জানে না। নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চারও সুযোগ নেই এখানে। অথচ মুণ্ডা জাতির রয়েছে সমৃদ্ধ ভাষা ও সংস্কৃতি।
চা শ্রমিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন কমলগঞ্জ সরকারি গণ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক দিপংকর শীল। তিনি জানান, চা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ অতিদরিদ্র হওয়ায় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চা সম্ভব হয় না। ভাষা-সংস্কৃতিচর্চা কমে আসায় তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও আজ সংকটের মুখে। আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেও তারা তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ধরে রাখতে পারছে না।
দিপংকর শীল বলেন, ‘চা জনগোষ্ঠীর সব ভাষা সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। অন্যদিকে কোনো ভাষার জনসংখ্যা কম হলে সহজেই তা হারিয়ে যায়। তবে বিপন্ন ভাষার গান, আবৃত্তি রেকর্ড করে সংরক্ষণ করতে পারলে কিছুটা রক্ষা করা সম্ভব।’
গবেষকরা জানান, বৃহত্তর সিলেটের চা বাগানগুলোয় কর্মরত চা শ্রমিকদের বড় ইতিহাস রয়েছে। চা চাষের জন্য ব্রিটিশরা তাদের ভারতের বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিয়ে আসে। প্রথম দিকে তারা যার যার ভাষা ব্যবহার করত। পরে আন্তঃযোগাযোগের কারণে বাংলার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে কথা বলার অভ্যাস তৈরি হয়।
এ বিষয়ে লোক গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, ‘প্রায় সব সূচকেই পিছিয়ে এসব ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। কারণ এরা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা সংখ্যালঘু ও বিচ্ছিন্ন হওয়ায় এবং সমাজে তাদের খাটো করে দেখার কারণে অনেকে বাধ্য হয়ে আত্মপরিচয় গোপন করছে। তাই এদের সংগঠিত করে তাদের জীবনচর্চা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে লালনের মাধ্যমে রক্ষা করা যেতে পারে। এ দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এদের রক্ষা করতে না পারলে আমাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র্যও একদিন হারিয়ে যাবে।’
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক ভাষা সমীক্ষায় বম, কোল, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, চাক, শো, খাসি, সৌরা, কোডা, মুণ্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, লালেং বা পাত্র ও লুসাই বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
মৌলভীবাজারের জেলা কালচারাল অফিসার জ্যোতি সিনহা বলেন, ‘জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সব নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে সরকারের কিছু উদ্যোগ রয়েছে।’