সফলতার গল্প স্যর আইজ্যাক নিউটন

টিবিটি ডেস্ক
টিবিটি ডেস্ক
প্রকাশিত: ৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:১৯ এএম
স্যর আইজ্যাক নিউটন

বিজ্ঞানের ইতিহাসে, স্যার আইজ্যাক নিউটনের নামটি নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়। কিন্তু এই নামের পিছনে যে হাড় কাঁপানো ইতিহাস রয়েছে তা কি জানেন? আমাদের জীবনে একটু বাঁধা আসলেই, আমরা ভেঙ্গে পড়ি, কিন্তু নিউটনের জীবনের গল্প পড়ার পড় আপনার মনে হবে, আপনি যে বাঁধাগুলির সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলি কিছুই নয়।


আইজ্যাক নিউটনের জন্মই হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের আগে। অর্থাৎ একজন স্বাভাবিক শিশু মাতৃগর্ভে যে পরিমাণ সময় থাকার পড় ভূমিষ্ট হয় তার অনেক আগেই। স্বভাবতই জন্মের পড় থেকেই তিনি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। এমন দুর্বল একটি শিশুর ভূমিষ্ট হওয়ার তিনমাসের মধ্যেই নিউটনের বাবা মারা যান।


পিতার দেহ ত্যাগের মাত্র তিন বছর পড়েই, নিউটনের মা আবার একটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সৎ বাবার কাছে ঠাই হয়নি শিশু নিউটনের। দুর্বল নিউটন তার দিদার কাছে বড় হতে থাকে। ভূমিষ্ট হওয়ার মাত্র তিন মাস পড়েই তিনি বাবাকে হারিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু মাত্র তিন বছর পড়েই, মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি।


যখন নিউটনের একটু বোঝার ক্ষমতা হল, তখন থেকেই তার মা এবং তার সৎ বাবার প্রতি একটি বিরূপ মনোভাব তার মধ্যে জন্ম হয়। পিতা-মাতার আদর আর মায়ের স্নেহ-মমতা ছাড়া বেড়ে উঠা, একজন শিশুর মধ্যে এরূপ মনোভাব জন্ম নেওয়াটাই স্বাভাবিক।


এরপর তাকে একটি স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানেই চলতে থাকে তার পড়াশোনা। নিউটনের বয়স যখন পনেরো বছর, তখনই তার সৎ পিতার মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পড়, নিউটনের মা, পুনরায় নিউটনের দিদার বাড়িতে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পড়েই, তিনি নিউটনের পড়াশোনা বন্ধ করে দেন, এবং তাকে খামারে কাজ করতে যেতে বলেন, যাতে করে কিছু অর্থ হাঁতে আসে!


কিন্তু নিউটন পড়াশোনা ছেড়ে খামারে কাজ করতে মোটেই ইচ্ছুক নয়। এমন পরিস্থিতিতে নিউটনের রক্ষাকর্তা হিসেবে নেমে আসেন একজন শিক্ষক। তিনি নিউটনের পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক দেখে, পুনরায় নিউটনের শ্রেণীকক্ষে ফেরার ব্যবস্থা করেন।


এত সংঘর্ষময় জীবনে থাকার পড়েও, তার জীবনে প্রেম এসেছিল। এক মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সেই প্রেম বিবাহে পরিণতি পায়। যখন তারা বিবাহ করেছিলেন, তখন নিউটনের বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই মেয়েটি নিউটনকে ছেড়ে চলে যান। যাকে তিনি জীবন সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন, সেও তাকে ছেড়ে চলে গেল। এরপর তিনি আবার একা হয়ে গেলেন। এরপর নিউটন সারাজীবন অবিবাহিত ছিলেন।


এভাবেই দুর্ভাগ্য নিয়ে তার পথ চলা শুরু হয়েছিল। কঠোর মনোবল নিয়েই আবার পড়াশোনায় মননিবেশ করলেন। রক্তে যার সংগ্রাম আছে, জীবনযুদ্ধে সে হারবে কিভাবে? ভাবছেন, তিনি পড়াশোনায় অত্যন্ত বিচক্ষন ছিলেন? উঁহু তা নয়। পড়াশোনায় তিনি ছিলেন মাঝারি ধরণের। তবে তার মধ্যে ‘বদলা’ এই শব্দটার প্রতিফলন প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত। তবে তার বদলা নেওয়া আর আমাদের বদলা নেওয়ার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক।


আমরা বদলা নেওয়া বলতে বুঝি, লড়াই করা। কিন্তু নিউটনের ক্ষেত্রে বদলা নেওয়ার অর্থ ছিল, নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে হাসিল করা। আর এই প্রচেষ্টাতে তিনি সফলও হয়েছিলেন। একবার স্কুলের এক ছাত্র তাকে নানান ভাবে অপমান করে। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে, পড়ের বছর মাঝারি মেধাবী ছাত্র নিউটন হয়ে গেলেন ক্লাসের সেরা ছাত্র।


কলেজ জীবনে তিনি কলেজের ফিস এবং নিজের খরচ চালানোর জন্য কলেজের একজন কর্মচারী হিসেবেও কাজ করতেন। সেই সময় বিজ্ঞান ছিল অ্যারিস্টটলের ধারণা কেন্দ্রিক। কিন্তু নিউটন চাইছিলেন, এই ধারণাকে আরও উন্নত এবং আধুনিক করতে। তিনি অ্যারিস্টটলের ধারনার মধ্যে কিছু একটা অনুপস্থিতি অনুভব করছিলেন। ১৬৬৪ সালে নিজ প্রতিভার কারণে কলেজ তাকে স্কলারশিপের বন্দোবস্ত করে দেয়।


এখান থেকেই তার ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। এরপর শুরু হল বিস্তর অধ্যয়ন ও নতুনকে জানার প্রচেষ্টা। আর এর পড়ের গল্প তা আমাদের সবারই জানা। মাধ্যাকর্ষণ থেকে শুরু করে, উড়োজাহাজ যে শর্তের উপর আজ আকাশে উড়ছে, সবই নিউনের গবেষণার ফলপ্রসূত।


নিউটনের এই সংঘর্ষময় জীবনের ইতিহাস জেনে আপনার কি মনে হচ্ছে, আপনার জীবন বেশি কঠিন? উঁহু মোটেই তা নয়। তিনি যদি এত কিছু বাঁধাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমান করতে পাড়েন আপনি কেন পাড়বেন না?


আমাদের সবার মধ্যেই কিছু না কিছু ট্যালেন্ট লুকিয়ে রয়েছে, শুধু দরকার সেই প্রতিভাকে খুঁজে বেড় করে, তার যথার্থতা প্রমান করার দৌড়ে শামিল হওয়া। সেই সময় অ্যারিস্টটলের আদর্শে পুড়ো বিজ্ঞান চলত, কিন্তু তার আদর্শের থেকেও নিউটন নিজের গবেষণাকে যেভাবে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন, তা শুধুই অনবদ্য নয়, বরং দুষ্করও বটে।


সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে অনেক বৈজ্ঞানিক ধারণা। পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে যাঁর হাত দিয়ে, তাঁর নাম আইজ্যাক নিউটন। আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটন সম্পর্কে বলেছিলেন, প্রকৃতি তাঁর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির রহস্য নিউটনের মতো করে আর কেউ এতটা উন্মোচন করতে পারেননি। নিউটনের হাত দিয়েই আমরা পেয়েছি আলো এবং বর্ণের সম্পর্ক, মহাকর্ষ বলের গাণিতিক সূত্র ও গতির সূত্র। 


জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউটনের গতিবিদ্যা প্রয়োগ করার পর বিগত কয়েক হাজার বছরের চেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। গণিতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা ক্যালকুলাসের উৎপত্তি ও বিকাশের অন্যতম নায়ক ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলোর একটি নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা, যেখান থেকে আমরা পেয়েছি চিরায়ত বলবিজ্ঞান (যাকে আমরা নিউটনীয় বলবিজ্ঞান বলি), গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর মধ্যে মহাকর্ষ বলের সূত্র এবং মহাবিশ্বের গতির গাণিতিক অবকাঠামো।


নিউটন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে দক্ষ ছিলেন। আলোক পরীক্ষার জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি তিনি নিজেই তৈরি করতেন। আলোক যন্ত্রপাতি তৈরি করতে করতে একটি শক্তিশালী রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ তৈরি করেন তিনি। এই টেলিস্কোপের কথা রয়্যাল সোসাইটিতে জানাজানি হয়ে যায়। বিজ্ঞানী রবার্ট বয়্যালের নেতৃত্বে রয়্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬০ সালে। রয়্যাল সোসাইটির আগ্রহে নিউটন তাঁর টেলিস্কোপের একটি মডেল রয়্যাল সোসাইটিতে পাঠান। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকে সর্বত্র। ১৬৭২ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ লাভ করেন নিউটন। রয়্যাল সোসাইটির নিয়ম অনুযায়ী নিউটনকে একটি বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিতে হয়। সেখানে তিনি অপটিকস–সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন।


১৬৬৫–৬৬ সালে প্লেগের সময় ফার্মে বসে নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন আলোর কণাতত্ত্ব। প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করিয়ে তিনি দেখেছেন প্রিজম থেকে বের হওয়ার সময় আলো বিভিন্ন বর্ণে আলাদা আলাদাভাবে বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল—এভাবে রংধনুর রঙে প্রতিসৃত হয়ে বের হয়। আরেকটি প্রিজমের ভেতর দিয়ে এই বর্ণালি প্রবেশ করিয়ে দেখা গেল, প্রিজমের অন্যদিকে সব কটি রং একসঙ্গে মিলে সাদা রঙের আলো বের হচ্ছে। আমরা কীভাবে রং দেখি, তার পদার্থবৈজ্ঞানিক উত্তর পাওয়া গেল। আমরা যখন লাল দেখি, তখন লাল ছাড়া বাকি সব রং শোষিত হয়। যখন সাদা দেখি, তখন সব রঙের মিশ্রণ দেখি। আর কালো মানে সব রঙের শোষণ।


কিন্তু নিউটনের গবেষণায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রবার্ট হুক। তিনি দাবি করেন, নিউটন তাঁর মডেল অনুসরণ করে এই যন্ত্র বানিয়েছেন, সুতরাং মূল কৃতিত্ব নিউটনের নয়। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস দাবি করলেন, নিউটন তাঁর তত্ত্ব নিয়েই কাজ করছেন। নিউটন ক্রমে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন। এই বিরোধ চলতেই থাকল পরবর্তী এক দশক ধরে।


১৬৭৯ সালে নিউটনের মা মারা যান। নিউটন একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ছোটবেলায় মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে সমগ্র নারী জাতির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল তাঁর। সারা জীবন তিনি নারীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেছেন।


১৬৮৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অ্যাডমন্ড হ্যালি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিউটনের সঙ্গে দেখা করেন। হ্যালি নিউটনকে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর গবেষণাকর্ম প্রকাশের জন্য। ১৬৮৪ থেকে ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত দিনরাত পরিশ্রম করে নিউটন তাঁর যুগান্তকারী বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। ১৬৮৬ সালের জুন মাসে তিনি রয়্যাল সোসাইটিতে উপস্থাপন করেন ফিলোসপিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা। পরের বছর তিন খণ্ডে এই বই প্রকাশিত হয়। তিনি ইচ্ছা করেই বইটিতে অনেক বেশি গাণিতিক সূত্র দিয়ে ভর্তি করে ফেলেন, যেন খুব বেশি মানুষ এই বই পড়ে বুঝতে না পারে। তাঁর ধারণা ছিল, কেউ কিছু বুঝতে না পারলে সমালোচনাও করতে পারবে না। তিনি মানুষের সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না।


১৬৮০ সাল থেকে ট্রিনিটি কলেজে ভীষণ অর্থাভাব দেখা দেয়। এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে ১৬৮৭ সালে আটজনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নিউটন ছিলেন সেই কমিটির অন্যতম সদস্য।


১৬৮৯ সালে নিউটন পার্লামেন্টের সদস্য মনোনীত হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এক বছর তিনি পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন। কিন্তু কথিত আছে, এই এক বছরে তিনি একটিমাত্র বাক্য বলেছিলেন পার্লামেন্টে। একজন সহকারীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘জানালাটা খুলে দাও।’


১৬৯৩ সালে নিউটনের প্রচণ্ড মানসিক সমস্যা দেয়। প্রায় চার মাস তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগেন। এরপর তিনি সুস্থ হলেও আর কোনো দিন কোনো মৌলিক গবেষণা করেননি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে ছিলেন ১৭০২ সাল পর্যন্ত।


১৬৯৬ সালে নিউটন ইংল্যান্ডের জাতীয় টাঁকশাল ‘রয়্যাল মিন্ট’-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দেন। এরপর ১৭২৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি এখানেই ছিলেন। পদোন্নতি হতে হতে তিনি ‘মাস্টার অব দ্য মিন্ট’ হয়েছিলেন। টাকা জাল করা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিউটনের দক্ষ ব্যবস্থাপনায়।


রবার্ট হুকের সঙ্গে বিরোধ চললেও ১৭০৩ সালে রবার্ট হুকের মৃত্যুর পর নিউটন রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি রাজনৈতিক এবং অন্যান্যভাবে প্রভাব খাটানোতে খুব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ১৭০৩ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কখনো কোনো প্রেস কনফারেন্স বা ঘোষণাপত্র পাঠ করেননি। জনসমাবেশে কিছু বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না।


১৭০৫ সালে নিউটন নাইটহুড লাভ করেন। তাঁর আগে আর কোনো বিজ্ঞানী এই সম্মান পাননি।



নিউটনকে কখনো হাসতে দেখা যায়নি। নিজের সমালোচনা একটুও সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। যাঁদের বন্ধু মনে করতেন, তাঁরাও যদি তাঁর পক্ষে কথা না বলতেন, তাহলে তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিতেন।


নিউটনের প্রিন্সিপিয়া পদার্থবিজ্ঞানে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনাগুলোর একটি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রচনা প্রকাশ করে বিখ্যাত হওয়ার পরেই তিনি প্রধান রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী বা ‘অ্যাস্ট্রোনোমার রয়্যাল’ জন ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে ঝগড়া লাগালেন। ফ্ল্যামস্টিডের সঙ্গে নিউটনের খুবই ভালো বন্ধুত্ব ছিল। প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের যেসব তথ্য–উপাত্ত দরকার হয়েছিল, তার সব কটিই তিনি পেয়েছিলেন ফ্ল্যামস্টিডের কাছ থেকে। কিন্তু নিউটন অপ্রকাশিত ডেটা চাইলে ফ্ল্যামস্টিড তা দিতে অস্বীকৃতি জানান, ফলে নিউটনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তিনি কোনো কিছুতেই না শুনতে পছন্দ করতেন না।


নিউটন নিজের প্রভাব খাটিয়ে রয়্যাল অবজারভেটরির পরিচালনা পরিষদের কর্তা হয়ে গেলেন এবং ডেটা দিতে বাধ্য করলেন। শুধু ডেটা পেয়েই সন্তুষ্ট হলেন না নিউটন। তিনি ফ্ল্যামস্টিডের নাম-নিশানা মুছে দিতে চাইলেন। ফ্ল্যামস্টিড যে ডেটা সংগ্রহ করেছিলেন, তার সব কটি বাজেয়াপ্ত করা হলো। ফ্ল্যামস্টিড যেসব গবেষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য রেডি হচ্ছিলেন, সেগুলোকে ফ্ল্যামস্টিডের শত্রু অ্যাডমন্ড হ্যালির নামে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন। 


কিন্তু ফ্ল্যামস্টিডও ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন। তিনি কোর্টে মামলা করলেন এবং দ্রুত কোর্ট অর্ডার পেলেন নিজের কাজের পক্ষে। ফ্ল্যামস্টিডের রচনা হ্যালির নামে প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েও নিউটন দমে গেলেন না। তিনি তাঁর প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণ থেকে ফ্ল্যামস্টিডের সব কটি রেফারেন্স মুছে দিলেন।


নিউটন অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ ছিলেন। জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লিবনিজের সঙ্গে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে বিরোধে সাংঘাতিকভাবে রেগে যান নিউটন। নিউটন আর লিবনিজ দুজনই আলাদাভাবে গণিতের এই নতুন শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিউটন লিবনিজের আগেই এই কাজ করলেও প্রকাশ করেছেন আরও অনেক দিন পর। কিন্তু লিবনিজ প্রকাশ করেছেন নিউটনের আগে।


ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব কাকে বেশি দেওয়া হবে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। লিবনিজের সমর্থনে একদল বিজ্ঞানী লিখলেন, নিউটনের পক্ষে লিখছেন আরেক দল। নিউটনের বন্ধুসংখ্যা কম হলেও তিনি অন্য পথ নিলেন। নিজেই নিজের পক্ষ সমর্থন করে লিখে তা বন্ধুদের নামে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। এভাবে নিয়মিত লিবনিজবিরোধী চিঠি প্রকাশিত হতে থাকলে লিবনিজ ব্যাপারটার একটা স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রয়্যাল সোসাইটির কাছেই বিচার দিলেন। কিন্তু লিবনিজ ভুলটা করলেন সেখানেই। নিউটন নিজেই তখন রয়্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। 


তিনি ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত কমিটি গঠন করবেন বলে নিজের বন্ধুদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করলেন। তাতেও শান্তি নেই তাঁর। নিজেই কমিটির রিপোর্ট লিখলেন এবং রয়্যাল সোসাইটিকে দিয়ে তা প্রকাশ করালেন। সেই রিপোর্টে লিবনিজকে সরাসরি দায়ী করা হয় নিউটনের কাজ চুরি করেছেন বলে। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে এই রিপোর্টের পক্ষে অনেক সুনাম করে বেনামে একটা চিঠিও প্রকাশ করলেন রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে। ১৭১৬ সালে লিবনিজের মৃত্যুর পর নির্লজ্জভাবে আনন্দ প্রকাশ করেন নিউটন।


১৭২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষবারের মতো রয়্যাল সোসাইটির মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেছেন নিউটন। এর এক মাস পরে ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁকে রাজকীয় সম্মান দিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে সমাহিত করা হয়।


সূত্র:

১. স্টিফেন হকিং—আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম


২. আইওয়ান জেমস—রিমার্কেবল ফিজিসিস্ট


৩. পিটার মুর—সায়েন্স


৪. স্টিভ পার্কার—আইজ্যাক নিউটন অ্যান্ড গ্র্যাভিটি


৫. লয়েড মর্টজ অ্যান্ড জেফারসন ওয়েভার—দ্য স্টোরি অব ফিজিকস


৬. জন গ্রিবিন—দ্য সায়েন্টিস্টস