সালাফী মানহাজ ও তার প্রয়োজনীয়তা

টিবিটি ডেস্ক
মাহফুজুর রহমান বিন আ. সাত্তার মাহমূদ
প্রকাশিত: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৩৯ পিএম

যাবতীয় প্রশংসা বিশ্ব জাহানের রব আল্লাহ তাআলার জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও ছাহাবায়ে কেরামের প্রতি।

সালাফ দ্বারা উদ্দেশ্য কী?

সালাফ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, এই উম্মতের প্রথম প্রজন্ম। তথা মুহাজির ও আনছার ছাহাবীগণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘আর মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তিনি তাদের জন্য তৈরি করেছেন জান্নাত, যার নিচে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এ তো মহাসাফল্য’ (আত-তাওবা, ৯/১০০)।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে মুহাজিরদের সম্পর্কে বলেন,لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ ‘এ সম্পদ নিঃস্ব মুহাজিরদের জন্য যারা নিজেদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির অন্বেষণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। এরাই তো সত্যাশ্রয়ী’ (আল-হাশর, ৫৯/৮)।

তারপর আনছারদের সম্পর্কে বলেন,وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘(আর এ সম্পদ তাদের জন্যও) যারা মুহাজিরদের আগমনের আগে এ নগরীকে নিবাস হিসেবে গ্ৰহণ করেছে ও ঈমান গ্রহণ করেছে, তারা তাদের কাছে যারা হিজরত করে এসেছে তাদের ভালোবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা তাদের অন্তরে কোনো (না পাওয়ার) হিংসা অনুভব করে না, আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্ৰাধিকার দেয়, নিজেরা অভাবগ্ৰস্ত হলেও। বস্তুত, যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম’ (আল-হাশর, ৫৯/৯)।

অতঃপর ছাহাবায়ে কেরাম, মুহাজির ও আনছারগণের পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মুসলিমদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ ‘আর যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু’ (আল-হাশর, ৫৯/১০)।

সালাফ দ্বারা আরও উদ্দেশ্য হলো তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা উত্তম যুগের অন্তর্ভুক্ত। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তম প্রজন্ম সম্পর্কে বলেছেন, خَيْرُكُمْ قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।

অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা’।[1] আর তাদের যুগ ছিল পরবর্তীদের যুগের চেয়ে শ্রেষ্ঠ যুগ, এ জন্যই এ যুগকে বলা হয়- عصر القرون المفضلة তথা ‘সর্বোৎকৃষ্ট যুগ’। তারাই হলো এ উম্মতের সালাফ, উম্মতের আদর্শ, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব যাদের প্রশংসায় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, خَيْرُكُمْ قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ‘আমার যুগের লোকেরাই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম। অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা, অতঃপর তাদের নিকটবর্তী যুগের লোকেরা’।[2]

মানহাজুস সালাফ কী?

সালাফগণ আক্বীদা, মুআমালাত, আখলাক-চরিত্রে এমনকি সর্বাবস্থায় যে পথে চলেছেন তাকে মানহাজুস সালাফ বলে। আর এ মানহাজটি সরাসরি কিতাব-সুন্নাহ থেকে গৃহীত। কেননা তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটেই থাকতেন, অহী নাযিল হওয়ার যুগের মানুষ ছিলেন এবং সরাসরি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ ইলম গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন, তাই তাদের প্রজন্মই হলো সবচেয়ে উত্তম প্রজন্ম এবং তাদের মানহাজই হলো সর্বোত্তম মানহাজ।

মানহাজুস সালাফ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তা অনুসরণ করতে হবে। সালাফে ছালেহীনের মানহাজ সর্বোত্তম মানহাজ। তাই মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো তাদের মানহাজ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা, যাতে যথাযথভাবে তা অনুসরণ করা যায়। কেননা সালাফদের মানহাজ সম্পর্কে জানা, জ্ঞানার্জন করা ও আমল করা ব্যতীত তাদের মানহাজের উপর চলা সম্ভব নয়।

এ জন্য আল্লাহ তাআলা বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ ‘আর মুহাজির ও আনছারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করে’ (আত-তাওবা, ৯/১০০)।

আর সালাফদের মতাদর্শ, মানহাজ এবং যে পথে তারা চলেছেন তা জানা ব্যতিরেকে যথার্থতার সহিত তাদের অনুসরণ করা সম্ভব নয়। তাই সালাফ কারা? তাদের মানহাজ কী? সে সম্পর্কে না জেনেই শুধু নিজেকে সালাফ বা সালাফিয়্যাতের দিকে সম্পৃক্ত করাতে কোনো ফায়েদা নেই, বরং কখনো কখনো তা ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। অতএব আমাদেরকে অবশ্যই সালাফে ছালেহীনের মানহাজ সম্পর্কে জানতে হবে।

এজন্য এ উম্মাতে মুহাম্মাদী অতি গুরুত্বের সাথে মানহাজুস সালাফ সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা করেন এবং যুগ যুগ ধরে তা প্রচার করছেন। তাই বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, ইনস্টিটিউট, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পড়ানো হয়। আর তা সম্পর্কে জানার উপায় হলো আল্লাহ তাআলার কিতাব ও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে গৃহীত মানহাজুস সালাফ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা।

মানহাজুস সালাফের প্রয়োজনীয়তা :

(১) মানহাজুস সালাফ আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব :

আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا ‘আর কারো নিকট সৎপথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করাবো আর তা কতই না মন্দ আবাস’ (আন-নিসা, ৪/১১৫)।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ‘আর যে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অনুসরণ করো’ (লুক্বমান, ৩১/১৫)। এই আয়াতের তাফসীরে ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন,و كل من الصحابة ينيب إلى الله فيجب اتباع سبيله و أقواله و اعتقاده من أكبر سبيله অর্থাৎ ‘আর প্রত্যেক ছাহাবী ছিলেন আল্লাহ তাআলার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। অতএব তাদের পথের অনুসরণ করা ওয়াজিব আর তাদের কথা ও আক্বীদা-বিশ্বাসসমূহ তাদের সবচেয়ে বড় পথগুলোর অন্যতম’।[3]

(২) ফেতনার সময় মুক্তির একমাত্র পথ হলো মানহাজুস সালাফ : নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় যবানে সংবাদ দিয়েছেন যে, অচিরেই এ উম্মতের মাঝে অনেক ইখতিলাফ দেখা দিবে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,افْتَرَقَتِ اليَهُودُ عَلَى إحْدَى وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَافْتَرَقَتِ النَّصَارَى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلُّهَا فِي النَّارِ إِلَّا وَاحِدَةً قَالُوْا : مَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ الجَمَاعَةُوَفِيْ رِوَايَةٍ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ ‘ইয়াহূদী ৭১ দলে এবং খ্রিষ্টান ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে আর এই উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে।

যার মধ্যে একটি ছাড়া বাকী সবগুলো জাহান্নামে যাবে’। অতঃপর ঐ একটি দল প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, ‘তারা হলো জামাআত’। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে মতাদর্শের উপর আছি তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে’।[4]

আর সালাফদের পথ তো তাই যার উপর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর ছাহাবীগণ ও যারা তাদের একনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন তারা ছিলেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে মানহাজুস সালাফ আঁকড়ে থাকতে হলে তা সম্পর্কে জানা খুবই প্রয়োজন; কেননা সালাফদের মানহাজই হলো একমাত্র মুক্তির পথ। যত দল-উপদল আছে সবগুলো জাহান্নামে যাবে তবে একটি ব্যতীত। আর সেটিই হলো আল ফেরক্বাতুন নাজিয়াহ, তারাই হলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ।

যখন মানুষের মাঝে বিভিন্ন মতানৈক্য দেখা দিবে; বিভিন্ন মতাদর্শ, ত্বরীক্বা দল-উপদল বৃদ্ধি পাবে তখন যে দলটি এগুলো থেকে মুক্ত থাকবে সে দলটিই হলো সালাফে ছালেহীনের মানহাজের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারা মানহাজুস সালাফ আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করবে।

(৩) স্বয়ং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানহাজুস সালাফ-এর উপর চলার অছিয়ত করেছেন : নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শেষ বয়সে উপনীত হয়ে ছাহাবীদের সামনে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হলো এবং অন্তরগুলো বিগলিত হলো। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! মনে হচ্ছে তা যেন বিদায়ী ভাষণ। সুতরাং আমাদেরকে কিছু অছিয়ত করুন।

তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ، وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَة ضلالة و كل ضلالة في النار ‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি, শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (আমীর) একজন হাবশী গোলাম হয়।

কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাত অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে কামড়ে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! (ধর্মে) প্রতিটি নব আবিষ্কার সম্পর্কে! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো বিদআত এবং প্রতিটি বিদআত হলো ভ্রষ্টতা। আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ’।[5]

এটা হলো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের জন্য তাঁর অছিয়ত, যেন তারা মানহাজুস সালাফ-এর উপর চলে। কেননা এটাই হলো মুক্তির পথ। আর এরূপ কথাই আল্লাহ তাআলা তাঁর বাণীতে উল্লেখ করেছেন,وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ‘আর এ পথই আমার সরল পথ, কাজেই তোমরা এর অনুসরণ করো এবং বিভিন্ন পথ অনুসরণ করবে না, করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা তাক্বওয়ার অধিকারী হও’ (আল-আনআম, ৬/১৫৩)।

জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকো, বিভ্রান্তি থেকে সতর্ক থাকো, ভ্রষ্ট দলসমূহের বিরোধিতা করো এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর ছাহাবীগণ ও তাদের অনুসারীদের সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত সত্যনিষ্ঠ সালাফদের মানহাজের উপর অবিচল থাকো।

আর যে ব্যক্তি এ মানহাজকে আঁকড়ে ধরবে, বিশেষ করে শেষ যামানায়, সে মানুষদের পক্ষ থেকে ও বিরোধীদের পক্ষ থেকে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হবে এবং তিরস্কার ও ধমক দেওয়া হবে, সে জন্য তার প্রয়োজন ধৈর্যের। তাকে এ সরল পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন জিনিসের প্রলোভন দেখানো হবে, বিভিন্ন বাতিল ফেরক্বা ও বিচ্যুত মানহাজ থেকে হুমকি দেওয়া হবে, তাদের এ দলে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহ দেওয়া হবে ও তাদের সাথে যোগ না দিলে ভয় দেখান হবে, এহেন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হবে ছবরের।

এজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ ‘ইসলাম শুরুতে অপরিচিত ছিল, অচিরেই তা আবার শুরুর মতো অপরিচিত হয়ে যাবে। সুতরাং এরূপ অপরিচিত অবস্থায়ও যারা ইসলামের উপর টিকে থাকবে তাদের জন্য সুসংবাদ’।[6]

সুতরাং দুনিয়ার ভ্রান্তি এবং পরকালে জাহান্নামের শাস্তি থেকে কেবল তারাই নিরাপদ থাকবে, মুক্তি পাবে যারা সালাফে ছালেহীনের মানহাজের উপর চলবে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا - ذَلِكَ الْفَضْلُ مِنَ اللَّهِ وَكَفَى بِاللَّهِ عَلِيمًا ‘আর কেউ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করলে সে নবী, ছিদ্দীক্ব (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী! এগুলো আল্লাহর অনুগ্রহ। সর্বজ্ঞ হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (আন-নিসা, ৪/৬৯-৭০)।

(৪) মানহাজুস সালাফ একমাত্র সরল সঠিক পথ : এ জন্য আল্লাহ তাআলা ছালাতের প্রত্যেক রাকআতে সূরা আল-ফাতেহা পড়া ওয়াজিব করেছেন। আর এ মহাগুরুত্বপূর্ণ দু‘আ সূরার শেষে আছে, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ ‘আমাদেরকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করো’ (আল-ফাতেহা, ১/৬)। আয়াতে সরল সঠিক পথের কথা বলা হয়েছে, কারণ সেখানে ধোঁকাময় বিচ্যুত আরো অনেক পথ রয়েছে।

তাই আপনি আল্লাহর কাছে চাইবেন তিনি যেন আপনাকে সকল প্রকার বিচ্যুত পথ থেকে দূরে রাখেন এবং সরল পথের দিশা দেন অর্থাৎ তিনি যেন আপনাকে ছিরাতুল মুস্তাক্বীমে পরিচালনা করেন এবং তার উপর অটল রাখেন। এ দু‘আটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে ছালাতের প্রতি রাকআতে তেলাওয়াত করাকে শরীআতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ এর অর্থ নিয়ে গভীরভাবে একটু চিন্তা করুন তো! আর কারা এ পথের পথিক তা নিয়ে একটু ভাবুন তো! এ পথের পথিক তো তারা, যাদের উপর আল্লাহ তাআলার নেয়ামত অবতীর্ণ হয়েছে।

صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ ‘তাদের পথ, যাদের উপর আপনি নেয়ামত দিয়েছেন’ (আল-ফাতেহা, ১/৭)। কাদের উপর আল্লাহ নেয়ামত দিয়েছেন? আল্লাহ তাআলা বলেছেন,مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا ‘ছিদ্দীক্ব (সত্যনিষ্ঠ), শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, তাদের সঙ্গী হবে এবং তারা কত উত্তম সঙ্গী’ (আন-নিসা, ৪/৬৯)।

আর যখন আপনি আল্লাহর কাছে এ পথের দিশা চাইবেন, তখন আরও দু‘আ করবেন, তিনি যেন বিচ্যুত পথ থেকে আপনাকে রক্ষা করেন। কারণ বিচ্যুত পথগুলো তাদের পথ যাদের উপর আল্লাহ তাআলা রাগান্বিত।

غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ ‘তাদের পথ নয়, যাদের উপর আপনি রাগান্বিত’ (আল-ফাতেহা, ১/৭)। আর তারা হলো ইয়াহূদী জাতি, যারা হক্ব জেনেছিল কিন্তু তার প্রতি আমল করেনি। এ উম্মতের মধ্য হতে যারাই ইয়াহূদীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, হক্ব জেনে তার প্রতি আমল করা থেকে বিরত থাকবে, তারাই ইয়াহূদীদের পথের উপর আছে, যাদের উপর আল্লাহ তাআলা রাগান্বিত। কারণ সে হক্ব জেনেছে কিন্তু তার প্রতি আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। জ্ঞান অর্জন করেছে আর তার প্রতি আমল পরিত্যাগ করেছে।

আর প্রত্যেক যে আলেম জ্ঞানার্জন করে কিন্তু সে জ্ঞানানুযায়ী আমল করে না, সেও ‘আল মাগযূবি আলাইহিম’-এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

وَلَا الضَّالِّينَ ‘আর তাদের পথও নয়, যারা পথভ্রষ্ট’ (আল-ফাতেহা, ১/৭)। আর তারা হলো যারা অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতার উপর থেকেই আল্লাহ তাআলার ইবাদত করে এবং যারা বেঠিক পথ, অনিরাপদ মানহাজের অনুসরণ করে; কুরআন-সুন্নাহর কোনো দলীলের প্রয়োজনবোধ করে না।

বিদআতের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে অথচ প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা। তারা আল্লাহর ইবাদত করে ও তাঁর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করে। যেমন— সে পথের উপর রয়েছে খ্রিষ্টানরা এবং যারা আল্লাহর ইবাদত করে, সঠিক পথ ও নিরাপদ মানহাজ ছেড়ে দিয়ে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারা সবাই বিভ্রান্ত এবং তাদের আমল বাতিল।

সুতরাং আমাদের উচিত হলো প্রতি রাকআতে পঠিত এ দু‘আটি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা, একাগ্রচিত্তে তা দ্বারা আল্লাহর নিকট দু‘আ করা এবং যথাযথভাবে তার অর্থ বুঝা, যাতে আমাদের দু‘আয় সাড়া দেওয়া হয়।

সূরা আল-ফাতেহা শেষে ‘আমীন’ বলতে হয়। আমীন অর্থ, ‘হে আল্লাহ! তুমি কবুল করো’। সুতরাং যে ব্যক্তি এ সূরাটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে তার নিকট স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাবে যে, তা একটি তাৎপর্যপূর্ণ দু‘আ।

সালাফী মানহাজে অটল থাকার জন্য ধৈর্য আবশ্যক। পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, যে ব্যক্তি নেয়ামতপ্রাপ্ত সালাফদের পথে চলবে তাকে পরীক্ষা করা হবে, বিপদে ফেলা হবে, তার উপর সংকীর্ণতা আরোপ করা হবে, কষ্ট দেওয়া হবে, হেয়জ্ঞান করা হবে, লাঞ্ছিত করা হবে, হুমকি দেওয়া হবে।

তাই এরূপ অবস্থায় প্রয়োজন ধৈর্যের। এ জন্য বিভিন্ন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, শেষ যামানায় দ্বীন আঁকড়ে ধরে থাকা কোনো ব্যক্তির হাতে জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে থাকার মতো কষ্টসাধ্য। কেননা সে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়, মানুষদের পক্ষ হতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যার কারণে মনে হয় সে যেন অঙ্গারের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তাই এরূপ অবস্থায় প্রয়োজন ধৈর্যের। 

এ পথটি মোটেও ফুলের গালিচা বিছানো পথের মতো নয়। অনুরূপভাবে তাতে বিপদাপদ ও কষ্ট কম নেই। তাছাড়াও তাতে রয়েছে মানুষদের পক্ষ থেকে অনিষ্ট। এ জন্য আপনি ধৈর্যধারণ করবেন, এ পথের উপর অটল থাকবেন। এমনকি আপনি আপনার রবের সাথে সাক্ষাৎ করবেন এমন অবস্থায় যে আপনি সালাফে ছালেহীনের মানহাজে অবিচল। যাতে আপনি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারেন।

দুনিয়ায় ভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত থাকতে পারেন এবং পরকালে জাহান্নাম থেকে নাজাত পেতে পারেন। সালাফদের পথ ছাড়া সত্য সঠিক কোনো পথ নেই, এ পথে চলা ছাড়া মুক্তির কোনো দিশা নেই। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও পুস্তকাদিতে সালাফদের মানহাজকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে, প্রকৃত সালাফী আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত-এর মর্যাদা হ্রাস করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, সালাফীরা কঠোর, উগ্র, তারা বেশি বেশি মানুষকে কাফের ট্যাগ দেয়, তারা এমন এমন ইত্যাদি।

কিন্তু তাদের এ অন্যায় অপপ্রচার সালাফীদের কোনো ক্ষতি করে না। তবে হ্যাঁ, যে সকল মানুষের ধৈর্য নেই, শক্তি ও দৃঢ় বিশ্বাস নেই তাদের উপর এসব অপপ্রচার প্রভাব বিস্তার করে ফেলে, তাদের ক্ষতি করে। অতএব, অবশ্যই ধৈর্যধারণ করতে হবে।

(ইনশা-আল্লাহ আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

মূল : ড. ছালেহ ইবনু ফাওযান আল-ফাওযান

-অনুবাদ : মাহফুজুর রহমান বিন আ. সাত্তার মাহমূদ

শিক্ষার্থী, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬৫১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩৫।


[2]. প্রাগুক্ত।


[3]. ই‘লাম, ৪/১২০।


[4]. তিরমিযী, হা/২৬৪০।


[5]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, হাদীছ ছহীহ।


[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫।


সূত্র: মাসিক আল-ইতিছাম