ঋণ প্রাপ্তিতে পিছিয়ে নারী
নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দেশে বাড়লেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণপ্রাপ্তির দিক দিয়ে এখনো পিছিয়ে তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সালের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণের যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, সেটি পূরণ করতে হলে ৯ মাসের মধ্যে ঋণের পরিমাণ বাড়াতে হবে দ্বিগুণেরও বেশি, যা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
নারী উদ্যোক্তারা বলছেন, তারা ব্যাংকে গেলে বাড়তি কিছু শর্ত দেওয়া হয়, ছোট অঙ্ক দিতে চায় না, যে কারণে সমবায় সমিতির কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয় তাদের। এতে বেড়ে যায় ব্যবসার খরচ।
যশোরের হাসিনা আক্তার কাজ করেন পাট নিয়ে। তার প্রতিষ্ঠানের নাম নুরি’জ জুট ক্রাফট।
নারী উদ্যোক্তাদের অধিকার নিয়েও তিনি কাজ করছেন প্রায় ২৫ বছর ধরে। যশোর স্ট্রিচ মহিলা উদ্যোগ সমিতি নামে একটি সংগঠনের সহ-সম্পাদকও তিনি।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন করা প্রতিষ্ঠানটি নারী উদ্যোক্তাদের অধিকার ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কাজ করে।
যখন ব্যবসা শুরু করেছেন, তখন অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টি এখনো ভুলতে পারেন না হাসিনা। তিনি বলেন, “দুই দশক আগে যখন ব্যবসা শুরু করি তখন কেউ ঋণ দিতে চায়নি। অনেক ব্যাংক আর ফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের সাহায্য চেয়েও পাইনি। পরে সমিতি থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় খাটাই।
“বহু আর্থিক বঞ্চনার পরে ব্যবসা আজকের অবস্থায় এসেছে। তাই নতুন উদ্যোক্তারা যেন বিনিয়োগ সুবিধা পান তার জন্য যশোর স্ট্রিচ মহিলা উদ্যোগ সমিতির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছি।”
নারীর ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে বাংলাদেশের নাম বিশ্বে উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সঙ্গেই। তবে দেশে এখনও আর্থিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত।
আরেক উদ্যোক্তা আরিফা নাজনীন বলছিলেন তাদের জন্য ব্যাংকগুলোর শর্ত কিছুটা কঠিন থাকে। তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারি জামিনদার চায়। পরিবারের সদস্য স্বামী বা বড় ভাইকে জামিনদার করা যাবে এমন সুবিধা দিলে অনেক নারীই বিনিয়োগের সুবিধা পেতে শুরু করবে।”
ছোট উদ্যোক্তারা বেশি সমস্যায় আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ব্যাংকগুলোর নতুন বা ছোট উদ্যোক্তাদের এক লাখ বা ছোট অঙ্কের ঋণ দেওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই তারা পাঁচ লাখের নিচে ঋণ পাস করেন না।
ছোট ঋণের জন্য সেই অর্থের প্রায় ২/৩ গুণ বেশি টাকার পণ্য মজুদ দেখানোর শর্ত দেওয়া হয়। ফলে অনেক নারীরই বিনিয়োগের সুবিধা নেন না।”
ব্যাংকের সহযোগিতা না পাওয়ায় কীভাবে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করে আরিফা বলেন, “ছোট উদ্যোক্তারা ২০/২৫ শতাংশ উচ্চ সুদে সমিতি থেকে দশ বা বিশ হাজার টাকার ছোট ঋণ নেন। কিন্তু এতে তার সপ্তাহ শেষেই টাকা পরিশোধের চাপ বেড়ে যায়।”
নবনীতা সাহা নামে আরেক জন উদ্যোক্তা বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পর পরিশোধের পরিসংখ্যানে পুরুষদের তুলনায় নারীদের সংখ্যা বেশি। তবুও নারীদের প্রতি বিনিয়োগের আগ্রহ কম ব্যাংকগুলোর। অনেক সময়েই দেখা যায় অল্প সংখ্যক নারীরা ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে বাকি নারী উদ্যোক্তাদেরও ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় ব্যাংক ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।”
দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা কত- সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পরিসংখ্যান না থাকলেও সংখ্যাটি ৫ লাখের বেশি বলে ধারণা করছে এসএমই ফাউন্ডেশন।
এসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তারা ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করছেন
নারীদের ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। এই খাতটি পরিচিত এসএমই নামে।
পরিসংখ্যান বলছে, নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে, কিন্তু তাদের সংখ্যার তুলনায় ঋণ তুলনামূলক কম।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান বলেন, “২০১০ থেকে এসএমই ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে নারীর অংশ বাড়ছে। ২০২০ সালে তাদের সংখ্যা ছিল ১৩.৮ শতাংশের বেশি।
কিন্তু সংখ্যা বাড়লেও মোট ঋণের ৬ শতাংশের কিছু বেশি পেয়েছেন নারীরা। পুরুষরা পাচ্ছেন প্রায় বাকি ৯৩ শতাংশ। এখানে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের একটি প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নারী উদ্যোক্তারা ৪৪ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তাদের জন্য বিশেষ ৪ শতাংশ সুদ হারে এই ঋণ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে এসএমই খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। এই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে নারীদের ঋণ বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বাড়াতে হবে।
এই বাস্তবতায় চলতি বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘নারীর সম অধিকার, সম সুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’।
বিসিক উদ্যোক্তা মেলা নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য প্রদর্শনের একটি সুযোগ নিয়ে এসেছে
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারীদের কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কিছু কাজ করলেও সেটি সীমিত।
২০২২-২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৮টি প্রকল্প এবং ২১ টি কর্মসূচির কথা উল্লেখ করা আছে। এসব প্রকল্পে ৪৯২টি উপজেলার ৪ হাজার ৫৭০টি ইউনিয়নে বাজেট ছিল ৪ কোটি ৪০ লাখ ৪০ হাজার ৪৫২ টাকা।
ওই বছর এসব প্রকল্পের মাধ্যমে ৯ হাজার ৬১০ জন নারীকে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ঋণও দেওয়া হয়।
নারী উদ্যোক্তাদেরকে ঋণ দিতে সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই নির্দেশনা আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইপিডিসি, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, আইডিএলসি ফাইন্যান্স এবং ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ, দ্য সিটি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংকে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার বিশেষ কর্মসূচি আছে।
অক্সফাম বাংলাদেশের প্রোগ্রাম কোয়ালিটি অফিসার বাসন্তী সন্ন্যাসী নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ও বিনিয়োগের বাস্তবের চিত্র নিয়ে বলেন, “করোনার পর নারীরা বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। প্রান্তিক ও মাঝারি দুই পর্যায়ের উদ্যোক্তাদেরই বিনিয়োগের প্রয়োজন।