২০২৪-২৭ মেয়াদ
রফতানি আয়ের লক্ষ্য ১১০ বিলিয়ন ডলার
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সুপারিশ সাপেক্ষে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ। ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বাজারে বর্তমানে যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা পাওয়া যায় তা আর মিলবে না।
বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে গড়ে ১০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রফতানি করতে হবে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের। এমন প্রেক্ষাপটেও ২০২৪-২৭ মেয়াদের নতুন নীতিতে ১১০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। যদিও তা অর্জন প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা।
রফতানি নীতি ২০২১-২৪-এর মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের জুনে। তাই খাতভিত্তিক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক আলোচনার মাধ্যমে তিন বছর মেয়াদি ২০২৪-২৭-এর খসড়া প্রণয়ন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চূড়ান্ত মতামতের জন্য নতুন নীতির খসড়াটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে। আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত এর ওপর মতামত নেয়া হবে।
রফতানি নীতির প্রাক-কথনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ এবং উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সরকার রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি কৌশল অনুসরণ করে আসছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সব মানদণ্ড অর্জনের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
যদিও জাতিসংঘ নির্ধারিত সময়ে এ উত্তরণ দেশের রফতানি খাতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) আওতায় আন্তর্জাতিক বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা হারানো বা সীমিত হওয়া। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার লক্ষ্যে অধিকতর প্রতিযোগী মূল্যে মানসম্মত পণ্য ও সেবা উৎপাদন, রফতানি পণ্য এবং বাজার বহুমুখীকরণ, বিনিয়োগ আকর্ষণ অত্যাবশ্যক।
রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে রফতানি নীতিতে আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে তা ২০২৭ সালের মধ্যে অর্জন প্রায় অসম্ভব। তবে তাদের দাবি, সুচিন্তিত ও কৌশলগত সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা গেলে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছা সম্ভব হলেও হতে পারে।
পাশাপাশি তারা এও বলছেন, সরকার প্রণীত রফতানি নীতিতে আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তা এখন পর্যন্ত কখনই বাস্তবে রূপ নেয়নি। এবারের লক্ষ্য পূরণ করা হবে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের। কেননা বিরাজমান বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতার শেষ কবে হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন।
রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রফতানি নীতিতে আয়ের লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভব। এখন সংকট সব দিকে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চাহিদা অনেক কমে গেছে। দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি সংকট। বেশি দামেও গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের সুদহারও বেড়েছে। আবার এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রেক্ষাপটে রফতানি সুবিধাও প্রত্যাহার হচ্ছে। সব মিলিয়ে লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভব।’
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, রফতানি নীতিতে আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় তা বেশির ভাগ সময়ই বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় না। অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হয়, লক্ষ্য যখন নির্ধারণ করতে হবে তা কিছুটা বাড়িয়েই করা খারাপ কিছু না! কিন্তু বাস্তবতা হলো, লক্ষ্য যদি বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হয় তাহলে নীতির আলোকে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যথাযথ না হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
তাছাড়া দেশের রফতানি আয়ের যে পরিসংখ্যান সেটা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন রয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে যেটা বলা হচ্ছে, তাতে দেখা যায় বাস্তবে রফতানির বিপরীতে অর্থপ্রাপ্তি অনেক কম। সব মিলিয়ে নীতি প্রণয়ন হওয়া উচিত বাস্তবতার নিরিখে।
রফতানি নীতি প্রণয়ন হয় তিন বছর মেয়াদি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৮ মেয়াদে রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হয় ৬০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮-২১ মেয়াদের নীতিতেও আয়ের লক্ষ্য অপরিবর্তিত ছিল। ২০২৪ সালের মধ্যে ৮০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ২০২১-২৪ মেয়াদের চলমান নীতিটি প্রণয়ন হয়েছিল।
আর নতুন মেয়াদের নীতির খসড়ায় ১১০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে। যদিও খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই মনে করে, বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হলে অন্যান্য রফতানিকারক দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
এদিকে রফতানির খসড়া নীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ও কৌশলগত বিরোধ এবং অর্থনৈতিক মন্দা ভাব, কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে বৈশ্বিক চাপ সত্ত্বেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য খাতে ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়। তবে কভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী আমদানি-রফতানি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এবং সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটায় পরের অর্থবছরে পণ্য খাতে ঋণাত্মক রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি খাত ঘুরে দাঁড়ায় এবং অর্জিত হয় ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।
প্রবৃদ্ধির সে ধারা অব্যাহত রাখতে দেশের প্রধান প্রধান শিল্প ও বণিক সমিতি, বাণিজ্য সংগঠন, গবেষণা সংস্থা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকারি বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা এবং তৎপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে রফতানি নীতি ২০২৪-২৭ প্রণয়ন হয়েছে।
খসড়া নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে আরো বলা হয়েছে, ২০২৪-২৭ মেয়াদে রফতানি আয় ১১০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক বাণিজ্য পরিবেশ সৃষ্টি ও সহজীকরণ। আর এ বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি ও উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সরকারের গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা সহজীকরণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি রফতানি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাধুনিক পরীক্ষাগার স্থাপন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় প্রকল্প বাস্তবায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে লেন সম্প্রসারণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণ, পায়রা ও মাতারবাড়ীতে দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর, রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট রফতানি খাতকে এগিয়ে নেবে।
নতুন রফতানি নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘১১০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি সম্ভব। জাতীয় শুল্ক নীতি বাস্তবায়ন এবং রফতানি বহুমুখীকরণের মাধ্যমে আমরা সে লক্ষ্য অর্জনে আত্মবিশ্বাসী।’