দাম নিয়ে শঙ্কা

খাতুনগঞ্জে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে

টিবিটি ডেস্ক
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:২৯ এএম

দেশে ভোগ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহৎ বাজার খাতুনগঞ্জে রমজান ঘিরে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। কয়েকটি পণ্যের দামও কমতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। পণ্য পরিবহনে সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

চট্টগ্রাম কাস্টম সূত্রে জানা গেছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের সাত মাস ১২ দিনে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ছোলা খালাস হয়েছে ৯৪ হাজার ৭৫৭ টন, মটর ৭৫ হাজার ৬৪৩ টন, মসুর ডাল ২ লাখ ২১ হাজার ৬৯৬ টন, সয়াবিন তেল ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬১ টন, পাম তেল ১০ লাখ ৭১ হাজার ১৫৯ টন এবং অপরিশোধিত চিনি (র সুগার) খালাস হয়েছে ৯ লাখ ১ হাজার ১২০ টন। এসময়ে ফ্রেশ খেজুর আমদানি হয়েছে ১৪ হাজার ১২১ টন এবং ড্রাইড খেজুর এসেছে ৯০৮ টন। পাশাপাশি স্থলবন্দর দিয়েও ভারত থেকে ছোলা ও মসুর ডাল আমদানি করছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা।

আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের মধ্যে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৩ দিনে বন্দরে ছোলা খালাস হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৫ টন, মটর ১ হাজার ১৪৩ টন, মসুর ডাল ৭৬ হাজার ৬৬১ টন, সয়াবিন তেল ৮৯ হাজার ৯০৬ টন, পাম তেল ১ লাখ ১৯ হাজার ৪০৩ টন, অপরিশোধিত চিনি (র সুগার) ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩২ টন, ফ্রেশ খেজুর ৫ হাজার ২২৯ টন এবং ড্রাইড খেজুর খালাস হয়েছে ৮৪ টন

এ বছর রমজানে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও মজুত রয়েছে বলে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদি তা-ই হয় তবে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। সেটা হলে ভোক্তারা সুফল পাবেন

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে এবার পণ্যের দাম আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। তারপরও রমজানে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন সচল রাখতে সরকারি নানা উদ্যোগে আমদানিকারকরা পর্যাপ্ত এলসি (ঋণপত্র) খোলেন।

বিশেষত, ভোগ্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে এবার আগেভাগে পদক্ষেপ নেয় সরকার। রমজানে বেশি চাহিদা থাকা পণ্যগুলো ৯০ দিনের সাপ্লাইয়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

ফলে পুরোনো আমদানিকরা এখন বাকিতেও পণ্য আমদানি করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে এলসি খোলার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ন্যূনতম পেমেন্ট দিয়েও রমজানের ভোগ্যপণ্য আমদানি করেন আমদানিকারকরা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিকারকরা বিশেষ এ সুবিধা পাবেন।

রমজান সামনে রেখে গত ৮ ফেব্রুয়ারি চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক কমানোর ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ নিয়ে পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে সংস্থাটি। এনবিআর ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। 

একই সঙ্গে এসব চাল আমদানিতে রেগুলেটরি ডিউটি (নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক) ২৫ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৫ মে পর্যন্ত চাল আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন।

অন্যদিকে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে, যা আগে ছিল টনপ্রতি দেড় হাজার টাকা। আর পরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে আমদানি শুল্ক কমিয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে, যা আগে তিন হাজার টাকা ছিল। শুল্ক ছাড়ের এ সুবিধা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বহাল থাকবে।

এছাড়া পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ের মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হয়েছে। এতে দেশে পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েলের উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোনো ভ্যাট দিতে হবে না। 

এছাড়া বিদেশ থেকে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। 

তার মানে সয়াবিন ও পাম অয়েলের আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট কমানো হয়েছে। একইভাবে খেজুর আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত আমদানিকারকরা এ সুবিধা পাবেন।

৪৩ দিনে বন্দরে ছোলা খালাস হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৫ টন, মটর ১ হাজার ১৪৩ টন, মসুর ডাল ৭৬ হাজার ৬৬১ টন, সয়াবিন তেল ৮৯ হাজার ৯০৬ টন, পাম তেল ১ লাখ ১৯ হাজার ৪০৩ টন, অপরিশোধিত চিনি (র সুগার) ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৩২ টন, ফ্রেশ খেজুর ৫ হাজার ২২৯ টন এবং ড্রাইড খেজুর খালাস হয়েছে ৮৪ টন

ব্যবসায়ীদের অনেকে বলছেন, আমদানি শুল্ক কমানোর প্রভাব এখনো পাইকারি বাজারে পড়েনি। সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলে বিশেষত তেল ও চিনিতে এ সুবিধা ভোক্তারা পেতে পারেন।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, রমজানে বেশি চাহিদা থাকে ছোলার। আমদানিকারকদের মতে, বছরে ছোলার চাহিদা প্রায় দুই লাখ থেকে সোয়া দুই লাখ টন। তার মধ্যে শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে ৭০ হাজার টনের বেশি। মানসম্মত ও দেখতে সুন্দর অস্ট্রেলিয়ান ছোলার চাহিদা বাংলাদেশে সবসময়ই বেশি। তবে বাজারে ভারতীয় ছোলার সরবরাহও রয়েছে।

যে ছোলা ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো, তা এখন ৩৪-৩৫ টাকায় মিলছে। বাজারে প্রচুর ছোলার মজুত রয়েছে। মটরের দামও প্রতি মণে ১০০-১৫০ টাকা কমেছে। এসব মটর রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা।

তিনি বলেন, বাজারে ভারতীয় চিকন মসুর ডাল ১২৮ টাকা এবং অস্ট্রেলিয়ান মাঝারি মসুর বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দরে। দুই মাস ধরে এ দামেই বিক্রি হয়ে আসছে। ছোলার মতো মসুরের প্রচুর আমদানি হয়েছে। বাজারে কোনো ঘাটতি নেই। মোকামেও পর্যাপ্ত মসুর রয়েছে।

তিনি বলেন, গত বছর এসময়ে ডলারের দাম ছিল ১০৫-১০৬ টাকা। এখন সেই ডলারের দাম দাঁড়িয়েছে ১২৫-১২৬ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট যা-ই থাকুক না কেন, গত বছরের তুলনায় প্রত্যেক পণ্যের ক্রয়মূল্য প্রায় ১৮-২০ শতাংশ করে বেড়েছে।

খাতুনগঞ্জে এস আলমের পাশাপাশি সিটি এবং মেঘনা গ্রুপের চিনি ও ভোজ্যতেলের কেনাবেচা হয়। গত এক বছরের ব্যবধানে প্রতি মণ চিনিতে এক হাজার টাকা দাম বেড়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে চিনির ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) মূল্য ছিল ৩৯২০-৩৯৩০ টাকা। রেডি চিনি কিনতে প্রতি মণে আরও ২০-৩০ টাকা বেশি গুনতে হয়ে পাইকারি ক্রেতাদের।

খাতুনগঞ্জে শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্র্যান্ডের চিনির ডিও প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৪৯২৫ টাকা। এক ব্র্যান্ডের রেডি চিনি ৪৯৪৫ টাকা। একই ভাবে সিটি গ্রুপের চিনির ডিও বিক্রি হচ্ছে ৪৯৩০ টাকায়।

খাতুনগঞ্জের ডিও ব্যবসায়ী আবু তাহের বলেন, ভোজ্যতেলের বাজারে খাতুনগঞ্জে পাম অয়েল বেশি কেনাবেচা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি খাতুনগঞ্জে এস আলম গ্রুপের পাম অয়েল ৪৮০০ টাকা, সিটি গ্রুপের পাম অয়েল ৪৮৪০ এবং মেঘনা গ্রুপের পাম অয়েল ৪৮৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ভোক্তাদের সংগঠন কনজ্যুরমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী এরই মধ্যে খাতুনগঞ্জ পরিদর্শন করেছেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। 

শুনেছি, তিনি মন্ত্রী হওয়ার পরদিনই ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এর অন্যতম কারণ নাকি তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে নরম সুরে কথা বলেন। তিনি (মন্ত্রী) কঠোর কোনো নির্দেশনা দেননি।

এই ক্যাব নেতা আরও বলেন, এ বছর রমজানে ভোগ্যপণ্যের পর্যাপ্ত আমদানি ও মজুত রয়েছে বলে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যদি তা-ই হয় তবে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ার কথা নয়। দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে কঠোর মনিটরিং প্রয়োজন। সেটা হলে ভোক্তারা সুফল পাবেন।