জরিমানা ও অভিযানেও দমেনি চালের দর
কোটি টাকা জরিমানা ও দেশজুড়ে ২০ দিনে তিন হাজারের বেশি সাঁড়াশি অভিযানেও আমনের এ মৌসুমে বাজারে চালের দাম পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। জানুয়ারিতে চড়তে শুরু করার সময় সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে বাড়ে ৫/৬ টাকা।
এরপর সরকারের জোরালো তৎপরতায় এক মাসের ব্যবধানে বেড়ে যাওয়া অবস্থান থেকে কমেছে কেজিতে সর্বোচ্চ তিন টাকা। এতে মৌসুমের মধ্যে চালের দাম এখনও আগের চেয়ে বেশি।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবই বলছে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে এসে আগের বেড়ে যাওয়া দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেনি। এতে আগের চড়া দামের বাজার পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের হয়নি।
খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তারা বলছেন, জানুয়ারিতে হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে কিছু কিছু চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা করে কমেছে। তবে অনেক চালই আগের মতোই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
তাদের মতে, চালের দরের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারির পর সারাদেশে বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে অসাধু ব্যবসায়ীদের কোটি টাকা জরিমানার পরও বাজারে এর প্রভাব তেমন একটা ফল রাখতে পারছে না।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল জরিমানা করে শুধু চাল নয়; কোনো পণ্যের বাজারই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পণ্য সরবরাহ বাড়িয়ে।
গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ও পরে চালকলগুলোতেই চালের দাম কেজিতে সর্বোচ্চ ৬ টাকা বেড়ে যায়। খুচরাও বাড়ে আরও বেশি।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে প্রধান এ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় সীমিত আয়ের মানুষ চাপে পড়ে। বাজারের অস্থিরতা দেখা দিলে তখন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার দাবি করেছিলেন, নির্বাচনি ব্যস্ততার সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে কারসাজি করেছে।
নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নতুন সরকারে পুরোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বই পান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র। এরপর গত ১৭ জানুয়ারি খাদ্য ভবনে দেশের শীর্ষস্থানীয় চালকল মালিক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা করেন। সেখানে ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই মন্তব্য করে চার দিনের মধ্যে চালের দাম আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের সময় বেঁধে দেন তিনি।
ঘোষণা অনুযায়ী ২১ জানুয়ারি থেকেই দেশজুড়ে গুদাম, চাতাল ও পাইকারি দোকানে শুরু হয় একের পর এক অভিযান। পাশাপাশি বাড়ানো হয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযানে অবৈধ মজুদসহ নিয়ম ভঙে জরিমানার খবর আসতে থাকে।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সেই সময় থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে মোট তিন হাজার ৩৭০টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এসব অভিযানে বিভিন্ন অনিয়ম, কারসাজি ও মজুদারির অপরাধে মোট এক কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৩৫০ টাকা জরিমানা আদায় করার তথ্য দিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন।
ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় সরব কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, জরিমানা বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নয়। বরং ব্যবসায়ীরা যে জরিমানা গুণলেন সেগুলো ভোক্তাদের কাছে বেশি দামে চাল বিক্রি করেই পুষিয়ে নেবেন। শেষ পর্যন্ত এসব জরিমানার খাড়া ভোক্তাদের ওপরই পড়বে এবং এখন তাই হচ্ছে।
বাজারে নিয়ন্ত্রণে সরকারি সরবরাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে সাবেক এ সচিব বলেন, সরকার যদি নিজস্ব সংগ্রহ থেকে বাজারে কিছু চাল ছেড়ে দিতে পারতো তাহলে বাজার এমনিতেই পড়ে যেত। কিন্তু ব্যবসায়ীরা যেহেতু জানে সরকারের কাছে এ কাজের প্রস্তুতি নেই; তাই বাজারও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
জরিমানার চেয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারাগারে পাঠাতে পারলে বেশি ফলাফল পাওয়া যেতো বলেও মনে করেন তিনি।
বুধবার কারওয়ান বাজারের চাল বিক্রেতা মোহাম্মদ রাসেল বলেন, নির্বাচনের পরপর চালের দাম যেভাবে বেড়ে গিয়েছিল এখন তার চেয়েও একটু কমেছে। অভিযান শুরুর পর নতুন করে দাম বাড়েনি। তবে এটা ঠিক যে, দামটা বেড়ে যাওয়ার আগে যেই অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ও ফিরে আসেনি।
সবশেষ দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সরু চালের ৫০ কেজির বস্তা ৩১০০ থেকে ৩৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চাল বা বিআর আটাশ চালের ৫০ কেজির বস্তা ২৫০০ থেকে ২৭০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গুটি স্বর্ণা বা মোটা চালের বস্তা ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির বাজার মনিটরিং তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে সরু চালের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে, মাঝারি চালের কেজি ৫২ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে, মোটা চাল ৪২ থেকে ৪২৮ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছিল। জানুয়ারির মাঝামাঝিতে দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বেড়ে সরু চালের কেজি সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা, মাঝারি চাল আগের মতোই কেজি ৫৫ টাকা এবং মোটা চাল সর্বোচ্চ ৫২ টাকায় বিক্রি হতে থাকে।
টিসিবির ১৪ ফেব্রুয়ারির বাজারদরের তথ্য বলছে, সরু চাল আগের মতোই প্রতিকেজি ৭৫ টাকা, মাঝারি চাল প্রতিকেজি ৫৫ টাকা এবং মোটা চাল ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ টিসিবির হিসাবেই চালের সর্বোচ্চ দরে কোনো তারতম্য হয়নি।
কয়েকজন ভোক্তা বলেন, নির্বাচনের আগে ও পরে দাম বেড়ে যাওয়ার পর সম্প্রতি কিছু কিছু চালের দাম কেজিতে ২/৩ টাকা করে কমেছে। তবে অনেক চালই আগের মতোই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা রাগিব হাসান বলেন, মাঝারি মানের চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে সরু চাল এক মাস আগের দরের আশপাশেই রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি সরু চালের ২৫ কেজির বস্তা কিনেছেন ১৬০০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ১৬৫০ টাকা।