জীবনে এমন দুর্যোগ কখনো দেখিনি: ড. ইউনূস
গ্রামীণ টেলিকমসহ আটটি প্রতিষ্ঠান বেদখল হওয়ার কথা তুলে ধরে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জীবনে বহু দুর্যোগ দেখেছেন। কিন্তু এমন দুর্যোগ আগে কখনো দেখেননি।
রাজধানীর মিরপুর ১ নম্বরে চিড়িয়াখানা সড়কে গ্রামীণ টেলিকম ভবনের নিচতলায় আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ড. ইউনূস।
সংবাদ সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম ও গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মঈনুদ্দিন চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আছি। কারণ, আমাদের আটটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল হয়ে গেছে। গ্রামীণ ব্যাংক এখন নিজেদের মতো করে এসব প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে।
১২ ফেব্রুয়ারি থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে তালা মেরে রেখেছে। নিজের বাড়িতে অন্য কেউ যদি তালা মারে, তখন কেমন লাগার কথা আপনারাই বলেন। তাহলে দেশে আইন–আদালত আছে কিসের জন্য?’
১৩ তলা গ্রামীণ টেলিকম ভবনে ড. ইউনূসের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটির চেয়ারম্যান ড. ইউনূস। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামীণ কল্যাণ; গ্রামীণ টেলিকম; গ্রামীণ শক্তি; গ্রামীণ সামগ্রী; গ্রামীণ ফান্ড; গ্রামীণ মৎস্য ও পশুসম্পদ ফাউন্ডেশন; গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশন এবং গ্রামীণ উদ্যোগ—এই আট প্রতিষ্ঠান ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ওই ঘটনার তিন দিনের মাথায় আজ বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ড. ইউনূস।
পুরো ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের হয়ে গিয়ে আমরা গ্রামীণ টেলিকম ভবনটি বানিয়েছি। এটি ছিল আমাদের স্বপ্নের বীজতলা।
আমাদের কর্মীরা নিয়মিত অফিস করছে; কাজকর্ম করছে। হঠাৎ চার দিন আগে বাইরের লোকজন এসে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জবরদখল করে ফেলল। আমরা তাদের কাছে বাইরের লোক হয়ে গেলাম। তারা তাদের মতো করে প্রতিষ্ঠান চালানোর চেষ্টা করছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী হতে যাচ্ছে।’
বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছে গিয়েও প্রতিকার পাননি বলে জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমার ঘর জবরদখল হয়ে যাচ্ছে। আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম, একটা জিডি করেছিলাম। জিডির কপি নিয়ে পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কোনো সমাধান দেয়নি। আমরা অফিস করতে পারছি না।’
সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক ড. ইউনূসকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি এত প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন কীভাবে? এত টাকা পেলেন কোথায়?’ জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘ব্যবসার মুনাফার টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় হয়নি। যা হয়েছে আইন মেনে হয়েছে।’
আরেক সাংবাদিক পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ইউনূসের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে ড. ইউনূস বলেন, পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার জন্য তাঁর তদবির করার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান গড়তে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া হয়নি।
গ্রামীণ ব্যাংক চাইলে গ্রামীণ পরিবারের অন্য প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে নিয়োগ দিতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, এটি আইনগত বিষয়। আইনিভাবে এর সুরাহা হবে। তাই বলে জবরদখল করে নয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন প্রতিদিন অফিস থেকে যাওয়ার সময় দরজায় তালা দিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘এটা আমরা কোন জগতে এসেছি? আমরা অফিস করতে পারব কি না, এটা তাদের এখতিয়ারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের যখন জিজ্ঞেস করি তারা বলে, এটি তাদের বাবার সম্পত্তি। আমরা নাকি এসব দখল করেছি। তারা আদালতে যেতে চায় না। তারা প্রমাণ করুক যে এটি তাদের সম্পত্তি। কিন্তু তারা সেসব করছে না।’
২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠা করা গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়। ২০১১ সালে ৬০ বছর বয়স হওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘হঠাৎ করে বাইরের লোক এসে বলবে, এটা আমাদের ঘর। এভাবে একটা দেশ চলে কীভাবে? আমাদের বিরুদ্ধে সকাল থেকে ঝাড়ুমিছিল হচ্ছে। কেন হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। আমরা নিজের বাড়িতেই আছি। দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। নার্সিং কলেজ হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে।
আমরা মানুষকে সেবা দিচ্ছি। প্রতিষ্ঠান যখন সফল, তখন বাইরের কিছু লোক এসে বলছে, আপনারা বের হয়ে যান। তখন আমরা কিছু বুঝতে পারি না। পুলিশকে বলেও লাভ হয়নি। এ জন্য দেশবাসীর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছি। আমরা কার কাছে যাব। তাই গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হয়েছি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, আজ সকাল সাতটার দিকে কিছু যুবক গ্রামীণ টেলিকম ভবনের সামনে এসে জড়ো হন। এ সময় কিছু নারী ঝাড়ু হাতে টেলিকম ভবনের সামনে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন।
ওই যুবকেরা সকাল ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গ্রামীণ টেলিকম ভবনের সামনে চেয়ারে বসে থাকেন। আবার কেউ মিছিল করেন। পরে তারা চলে যান। সকাল ১০টা থেকে অফিস সময় থাকলেও এ সময় গ্রামীণ পরিবারের কর্মীদের বাইরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে ওই যুবকেরা চলে গেলে গ্রামীণ টেলিকম ভবনের কর্মীদের কার্ড দেখে দেখে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। অন্যান্য দিনের মতো আজও গ্রামীণ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা এই ভবনে অফিস করেছেন।