হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য কেমন জানান দিতে পারে ত্বক

টিবিটি ডেস্ক
টিবিটি ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০২:১৪ এএম

কখন কী প্রয়োজন ত্বক সেটা জানান দেয়। আর আমাদের উচিত সেগুলোর গুরুত্ব দেওয়া।

লালচে বা চামড়া ওঠার সমস্যা দেখা দেওয়ার মাধ্যমে ত্বক জানান দেয়- হয় অ্যালার্জি নয়তো শুষ্কতার সমস্যা। একইভাবে খসখসের ত্বকে জানান দেয় শরীরের আর্দ্রতার প্রয়োজন।

“দেহের সবচেয়ে বড় অঙ্গ হিসেবে ত্বকের কথা আমাদের শোনা উচিত”- ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এভাবেই মন্তব্য করেন মার্কিন ত্বক-বিশেষজ্ঞ স্যাম আওয়ান।

‘ইউ.এস. ডার্মাটোলজি পার্টনার্স ম্যাককিনে’র সাথে নিযুক্ত এই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন, “তাই স্বাস্থ্যের অবস্থা বোঝার জন্য সহজ আয়না হতে পারে আমাদের ত্বক।

প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞরা নানান জটিল পরীক্ষা ছাড়াই ত্বকের স্বাস্থ্য থেকে দেহের অবস্থা আন্দাজ করে নিতে পারেন।

যেমন- ত্বকের রং যদি হলদে লাগে তবে বুঝতে হবে যকৃত সংক্রান্ত কোনো সমস্যা চলছে। যেমন- জন্ডিস। আবার হাড়ের জোড়ের চামড়ার আশপাশে যদি ফুলে ওঠে তবে হতে পারে সেটা রিউমাটয়েড আর্থ্র্রাইটের লক্ষণ।

একইভাবে হৃদস্বাস্থ্যের বিষয়ে জানান দিতে পারে ত্বক। এমকি বয়সের সাথে সাথে ত্বকের কিছু পরিবর্তন দেখে প্রাথমিক অবস্থাতেই হৃদ-সংক্রান্ত অসুস্থার লক্ষণ আন্দাজ করা যায়।

বিবর্ণ ত্বক
ত্বকের বিভিন্ন রং হয়। এমনকি কোনো কোনো সময় গোলাপি/ লালচে হতে পারে। তবে যদি দেখা যায় নীলচেভাব, সেটার মানে অন্য হতে পারে।

“ত্বক নীল বা বেগুনি রং ধারণ করার মানে হতে পারে অক্সিজেন ঠিকমতো আবর্তিত হচ্ছে না”- বলেন নিউ ইয়র্ক’য়ের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘নর্থওয়েল হেল্থ’য়ের হৃদ-বিশেষজ্ঞ স্টেসি রোজেন।

মায়ো ক্লিনিক’য়ের তথ্যানুসারে, ত্বক নীল বর্ণ ধারণ করার নাম হল ‘সাইয়্যানসিস’।

যখন দেহের কোনো অংশে রক্ত প্রবাহের মাত্রা কমে যায় তখন এই অবস্থা হয়। হতে পারে সেটা পা কিংবা হাতের আঙ্গুলে।

তবে মনে রাখতে হবে, সব সময় আঙ্গুল নীল হওয়ার সাথে হৃদরোগের সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। যেমন- কোভিড ১৯ বা ‘অটোইমিউন’ অবস্থার কারণেও এরকম হতে পারে- জানান ডা. আওয়ান।

এছাড়া অন্যান্য কারণে মধ্যে আছে ছোটখাট রক্তজমাট বাঁধা বা আটকে যাওয়া।

ডা. আওয়ান আরও বলেন, “শুধু নীল বা বেগুনি নয়, ত্বকের ‘হাইপারপিগমেন্টেইশন’ বা চামড়ার কোনো অংশ কিঞ্চিত গাঢ় বা কালচে হওয়াকে বলে- ‘অ্যাকানথোসিস নাইগ্রকান্স’। এর ফলে ঘাড় বা বাহুমূলে সামান্য কালচেভাব হয়।

ডা. আওয়ান বলেন, “এই অবস্থা হতে পারে ‘ইন্সুলিন প্রতিরোধী’ হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। যা টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার উপসর্গ হিসেবে পরিচিত।”

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা’র তথ্যানুসারে- এর ফলে হৃদরোগ ও স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

যে কারণে নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষার পরামর্শ দেন, ডা. আওয়ান। পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার, ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে পারলে ‘ইন্সুলিন প্রতিরোধী’ হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়।

পা ফোলা
হৃদস্বাস্থের অবস্থা বোঝার জন্য শুধু ত্বকের রংয়ের দিকেই নয় আকার আকৃতির দিকেও নজর রাখতে হবে। আর সেটা হল পা ফোলার সমস্যা। যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘এডিমা’।

ডা. রোজেন বলেন, “এটা হতে পারে হৃদরোগ হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ।”

নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, ‘এডিমা’ হল ‘হার্ট ফেইল’য়ের প্রচলিত উপসর্গ। হৃদস্বাস্থ্যের সমস্যা হলে, পা বা গোড়ালি ফুলতে থাকে।

হার্ভার্ড হেল্থ’য়ের তথ্যানুসারে- এর কারণ হল, হৃদযন্ত্র তখন দেহের নিম্নভাগ থেকে জোরালোভাবে রক্ত তুলে আনতে পারে না। যে কারণে পা, গোড়ালি, উরু বা তলপেটে অতিরিক্ত তরল জমতে শুরু করে।  

মায়ো ক্লিনিকের তথ্যানুসারে ‘হার্ট ফেইলুয়ার’য়ের আরও লক্ষণের মধ্যে আছে-

কোনো কাজ করতে গেলে বা শুয়ে থাকলে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা।

অবসাদ ও ক্লান্তি
বুক ধরফর করা বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন

কফ না সারা বা শ্লেষ্মার সাথে রক্ত আসা।

অরুচি ও পেট গোলানো

মনোযোগের অভাব

বুকে ব্যথা (যদি হার্ট ফেইলুয়ার থেকে হার্ট অ্যাটাক হয়)।

ডা. আওয়ান বলেন, “হৃদযন্ত্র, ফুসফুস বা বৃক্কের সমস্যার রক্ষণ হতে পারে পায়ের পাতা বা পা ফোলা।”

তবে ডা. আওয়ান আরও বলেন, “যদি হঠাৎ করে কোনো একটি পা ফুলে ওঠে তবে সেটা হতে পারে রক্ত জমাট বাঁধার প্রাথমিক লক্ষণ বা ‘ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি)’। এরকম অবস্থায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।”

পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ‘ডিভিটি’ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া অনেকক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকলে, বসে অনেক দূর ভ্রমণ করলে বা কোনো নড়াচড়া না করলেও এরকম হয়- জানান ডা. আওয়ান।

আঙ্গুল ফোলা
“হাত বা পায়ের আঙ্গুলের নখের আশপাশ যদি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ফুলে ওঠে তবে সেটা হতে পারে হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের রোগের প্রাথমিক লক্ষণ”- বলেন ডা. আওয়ান।

এরফলে আঙ্গুল ফুলে ওঠার পাশাপাশি নক বাঁকা হয়ে যায়।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক এই সমস্যার সাথে হৃদরোগের সম্পর্ক রয়েছে বলে জানায়। এরকম হওয়ার কারণগুলো হল-

অ্যারোটিকা নিউরিজম: প্রধান ধমনি, যেটার মাধ্যমে হৃদযন্ত্র থেকে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ হয় সেটার দেওয়াল ফুলে যাওয়া।

কনজেনিটল হার্ট ডিজিজ: জন্মগত হৃদরোগ।

এন্ডোকার্ডাইটিস: রক্তপ্রবাহে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের কারণে হৃদযন্ত্রের ভাল্বের স্তরে প্রদাহ হওয়া।

ম্যানিকিওর বা পেডিকিওর করলেও আঙ্গুল ফুলে যেতে পারে। বাসায় নখ কাটতে গিয়ে বেশি ছোট করে ফেললে; এমনকি গোসলের পর লোশন ব্যবহারেও এরকম হতে পারে।

এই সমস্যা দেখা দেওয়া মাত্র দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

চোখের পাতা বা আশপাশে ক্ষত
ডা. রোজেন বলেন, “যদি চোখের পাপড়িতে হলদে বা কমলা রংয়ের মতো চামড়া বেড়ে ওঠে বা ত্বকের কোথাও মোমের মতো ফোলা দেখা দেয়, তবে সেটা হল উচ্চ কোলেস্টেরল বা ডায়াবেটিসের লক্ষণ।”

এই অবস্থাকে বলা হয় ‘ক্সান্থোমাস’। বিশেষ করে বৃদ্ধদের মাঝে বেশি দেখা দেয়।

‘আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’য়ের তথ্যানুসারে উচ্চ কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

‘ক্সান্থোমাস’ নিজে থেকে সেরে যায় না। এজন্য ত্বক বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক পরামর্শ দিচ্ছে, হৃদস্বাস্থ্য ভালো রাখতে কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি তামাক গ্রহণ থেকে দূরে থাকতে হবে।

নখে বেগুনি দাগ
নখ আসলে ত্বকের কোষ দিয়েই গঠিত হয়। আর ত্বকের মতো চুল এবং নখ দেহের বাইরের স্তর। শরীরের ভেতরের সমস্যা যেমন ত্বকে দেখা দেয় তেমনি নখেও ফুটে ওঠে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের তথ্যানুসারে- হৃদরোগ সম্পর্কিত নখের পরিবর্তনকে বলা হয় ‘স্প্লিন্টার হেমোরিজ’। এর ফলে নখে লম্বা লম্বা বেগুনি দাগ দেখা দেয়।

ডা. রোজেন বলেন, “দেখলে মনে হবে কাঠের চিকন কোনো টুকরা নখের ভেতর ঢুকে বসে আছে। সাধারণত নখে আঘাত লাগলে এরকম হতে পারে। তবে এর সাথে হৃদ-সমস্যাও জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে যদি কয়েকটি নখে বেগুনি দাগ দেখা দেয়।”

তিনি আরও বলেন, “আঙ্গুলের আগা ফোলার সাথে নখের পরিবর্তন, লাল বা নীলচে দাগ দেখা দেওয়া হতে পারে হৃদরোগ, হৃদ-সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগের লক্ষণ।”

‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অফ ডার্মাটোলজি’র তথ্যানুসারে, যদি হৃদ-সংক্রান্ত সমস্যা হয় তবে লালচে বা বেগুনি দাগের সাথে অন্যান্য লক্ষণও দেখা দেবে, যেমন- অনেক জ্বর, দুর্বলতা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন অথবা ক্লান্তি।

যদি আঘাতের কারণে ‘স্প্লিন্টার হেমোরিজ’ হয়, সেক্ষেত্রে সাধারণত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে না। তবে আঘাত ছাড়াই যদি দেখা দেয় তখন ত্বক-বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায় যেভাবে ত্বকের যত্নের রুটিন উন্নত করা যায়

প্রাথমিক লক্ষণে হৃদরোগ ধরতে পারলে বিপদের ঝুঁকি কমানো যায়।

ডা. আওয়ান পরামর্শ দেন, “এজন্য নিয়মিত হাত-পায়ের আঙ্গুল পরীক্ষার করার পাশাপাশি প্রতিদিনের ত্বক পরিচর্যায় কিছু বিষয় নিয়মিত নজর রাখা উচিত।”

এসবের মধ্যে রয়েছে-
ক্রিম বা ময়েশ্চারাইজার মাখার সময় চোখের পাতা ও আশপাশ ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করা। মোমের মতো ফোলাভাব দেখা দিলে, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

ম্যানিকিউর বা পেডিকিউর করার সময় নখ ও আঙ্গুলের মাথার দিকে নজর দেওয়া। যে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পায়ে লোশন মাখার সময় খেয়াল করা কোথাও ফোলাভাব হয়েছে কিনা। পাশাপাশি ত্বকে ফোলাভাব বা পরিবর্তন ও কোনো অস্বাভাবিক লালচেভাব আছে কিনা খেয়াল করা।

গোসলে সাবান বা বডিওয়াশ ব্যবহারের সময় ত্বকের রংয়ে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কিনা নিয়মিত পরীক্ষা করা।

মনে রাখতে হবে, এই ধরনের ত্বকের পরিবর্তন মানেই যে হৃদরোগ হয়েছে- সেটা কিন্তু নয়। অন্য কারণেও সেসব হতে পারে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় সাবধান হতে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরি।