গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ কমাবে কাঁচা ঘাস
পশুখাদ্য হিসেবে দানাদার খাদ্যের বাইরে সবুজ ঘাষ গবাদিপশুর উৎপাদন খরচ কমাবে। এ জন্য কাঁচা ঘাসের বিকল্প নেই। উৎপাদন খরচ কমিয়ে, পশুর শরীরের যথাযথ পুষ্টির জোগান নিশ্চিতে দৈনিক তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচা ঘাস যুক্ত করা খুবই জরুরি। উৎপাদন খরচ কমলে বাজারে কমবে মাংস ও দুধের দাম।
সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টায় সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে গত দুই দশকে বাংলাদেশে মাংস ও দুধের উৎপাদন বেড়েছে ব্যাপকভাবে। ফলে বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে ইতোমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দুধ উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে।
সরকার সার্বিক প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে, তথা মাংস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য খামারিদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করছে, যা এ দেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তবে মাংস ও দুধের দাম বেশি হওয়ায় সরকারের এই প্রচেষ্টা সাধারণ মানুষের কল্যাণে অনেকটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, পশুখাদ্যের অন্যতম উপাদান হলো ঘাস। সবুজ ঘাস পশুর খুব পছন্দের খাবার। পশুর বেঁচে থাকা ও দৈহিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উপাদান লুকিয়ে রয়েছে এই ঘাসে। তা ছাড়া বর্তমান বাজারে দানাদার খাদ্যের চেয়ে কাঁচা ঘাসের দাম অনেক কম। তাই পশুখাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে দৈনিক খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে কাঁচা ঘাস। পশু পালনের ক্ষেত্রে গুণগত খাদ্য সরবরাহের ওপর নির্ভর করবে মাংসের উৎপাদন।
উৎপাদনের বড় খরচ হচ্ছে খাদ্যের খরচ (প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ)। কাজেই উচ্চমূলের দানাদার খাবারের ওপর বেশি নির্ভরশীল না হয়ে উন্নত জাতের অধিক পুষ্টিসম্পন্ন ঘাস চাষের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং সাইলেজ ব্যবহারের জন্য গুরুত্বারোপ করতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ কম হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে যেসব ঘাস পাওয়া যায়, এর মধ্যে কিছু হলো স্থায়ী ঘাস আর কিছু অস্থায়ী বা মৌসুমি ঘাস। স্থায়ী ঘাসগুলো একবার লাগালে কয়েক বছর বেঁচে থাকে এবং বছর বছর সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু মৌসুমি ঘাসগুলো একবার কেটে খাওয়ালেই শেষ। স্থায়ী ঘাসের মধ্যে রয়েছে নেপিয়ার, জার্মান পারা, ডেসমোডিয়ার ইত্যাদি। আবার অস্থায়ী ঘাসের মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, সরগম মাষকলাই ইত্যাদি। এসব ঘাসের মধ্যে কিছু আবার নডিউল যুক্ত। যেমন খোসারি, শিম ইত্যাদি।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গবাদিপশুর জন্য এক কেজি দানাদার খাদ্য কিনতে ব্যয় হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে এক কেজি সবুজ ঘাস কিনতে কৃষকের খরচ করতে হয় মাত্র ৪ থেকে ৫ টাকা। পুষ্টির দিক থেকে সবুজ ঘাস অতি উন্নত মানের বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানিয়েছেন, অনেক খামারি পশুকে সারা দিনই সবুজ ঘাসের পরিবর্তে দানাদার খাদ্য দেন। একটি পশু যদি দিনে পাঁচ কেজি দানাদার খাবার খায়, তাহলে পশুটিকে দিনে ২৫০ থেকে ২৭৫ টাকার খাবার দিতে হয়। অন্যদিকে পূর্ণবয়স্ক একটি গরুর ক্ষেত্রে পাঁচ কেজি খাদ্যের মধ্যে চার কেজি সবুজ ঘাসের সঙ্গে এক কেজি দানাদার খাদ্যর প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে খামারির ব্যয় হবে মাত্র ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এর বেশি প্রয়োজন নেই। এই হারে পশুকে খাবার জোগান দিলে উৎপাদন খরচ কমবে। খামারির খরচ কম হলে বাজারে মাংস ও দুধের দাম কম হবে, যা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন তারা।
জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত জাতের ঘাস চাষের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কৃষকদের মধ্যে। নিজের খামারের গরুর জন্যই এই ঘাস চাষ করেন খামারিরা। খামার লাভজনক করতে হলে দানাদার খাদ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বেশি বেশি কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে, যা পশুর শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয়।
ঘাসের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঁচা ঘাসের বেশির ভাগ অংশজুড়ে থাকে পানি। এই পানি বা জলীয় অংশ বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো ড্রাইমেটার বা শুষ্ক অংশ। মূলত খাদ্যের পাঁচটি উপাদান শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, মিনারেল ও আঁশজাতীয় বিভিন্ন উপাদান থাকে এই অংশে।
গবাদিপশু বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পুষ্টি ঘাসের জলীয় অংশের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় যে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেড থাকে, তা সহজে ঘাস থেকে রুমেনে চলে আসে। এই শর্করা রুমেনের মাইক্রোফ্লোরাগুলোকে দ্রুত শক্তিশালী করে তোলে। ফলে রুমেনে যে ঘাসজাতীয় খাদ্য থাকে, তার হজমপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এই শর্করাই সাইলেজের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে এর পুষ্টিমান বাড়ে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানিয়েছেন, ঘাস থেকে পাওয়া প্রোটিন অনেক সহজলভ্য। পশুখাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দামি উপাদান হলো আমিষ বা প্রোটিন। আমদানি করা প্রোটিনের চেয়ে ঘাস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন অনেক সস্তা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. সুচয়ন চৌধুরী বলেছেন, ঘাসে যে প্রোটিন পাওয়া যায়, তা মূলত ক্রুড প্রোটিন; যেখানে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ৬ দশমিক ২৫ গুণ বেশি। এই ক্রুড প্রোটিনের ৮০ শতাংশ হলো ট্রু প্রোটিন, অবশিষ্ট অংশটুকু হলো নন-প্রোটিন নাট্রোজেন। দুই ধরনের প্রোটিনই পশুর শরীরে ব্যবহৃত হয়। তবে ট্রু প্রোটিন পশুর শরীরে মাংস ও দুধ বাড়াতে সহায়তা করে।
আর নন-প্রোটিন নাইট্রোজেনের বেশির ভাগ অংশ পশুর শরীর থেকে বের হয়ে যায়। ক্রুড প্রোটিন রুমেনে দুভাবে বিভক্ত হয়, যার একটি অংশ রুমেনের অণুজীব দ্বারা ভেঙে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে পরিণত হয়; যা পরবর্তী সময়ে মাইক্রোবসের সঙ্গে হজম হয়ে যায়। আর বাকি অংশ রুমেনে হজম না হয়ে ক্ষুদ্রান্তে চলে আসে এবং সেখানে হজম হয়।
তিনি আরও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, পশু যে পরিমাণ প্রোটিন গ্রহণ করে, তার ২০ শতাংশ শরীরে কাজে লাগে বাকিগুলো বর্জ্য হিসেবে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। মূলত ট্রু প্রোটিনটি পশুর কাজে লাগে। পশুর খাদ্য উপাদানের মধ্যে অন্যতম হলো আঁশ বা ফাইবার। রুমেনে খাদ্য নড়াচড়া করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ফাইবার। পশুখাদ্যে আঁশজাতীয় খাদ্য পর্যাপ্ত থাকলে রুমেনে খাদ্যের পরিপাক সঠিক সময়ে শেষ হয়, তাই পশুর নিজে থেকে খাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয়। এ জন্য খাদ্যে ড্রাই মেটারের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আঁশ থাকা প্রয়োজন।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের (ডিএলএস, ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে বাংলাদেশে মাংসের উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২১-২২ সালে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯৩ লাখ মেট্রিক টন (প্রায় ১০ গুণ)। মোট মাংস উৎপাদনের একটি বড় অংশ (প্রায় ৪৯ দশমিক ৮১ শতাংশ) আসে গরু থেকে (ডিএলএস, ২০২৩)। যদিও গত ১০ বছরে গরুর সংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফ) এবং ডিএলএসের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১২ লাখ খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ৯৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় সবুজ ঘাসের চাষ হচ্ছে, হচ্ছে সেখানে উৎপাদিত ঘাসের বাজারজাতকরণ। সেখানে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এগুলোর মধ্যে দেশের উত্তারাঞ্চলের বিশেষ করে দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলায় গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে সবুজ ঘাসের চাহিদা এবং উৎপাদন ব্যাপক। এখানকার বেশির ভাগ বাজারে সপ্তাহের একাধিক দিন হাটে বিক্রি হয় সবুজ ঘাস। কেনাবেচা হয় লাখ লাখ টাকার ঘাস।