দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়ছে সাপের কামড়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমান অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৫৫ লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায়। সেই সঙ্গে পৃথিবীতে যে পরিমাণ মানুষকে সাপ কামড়ায় তার অর্ধেকই বিষধর সাপ। বিষধর সাপের কামড়ে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। ডব্লিউএইচও এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ সাপে কাটার ঘটনা রেকর্ড করা হয় এবং এতে প্রায় ৫৮ হাজার মানুষ মারা যায়।
সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। শ্রীলঙ্কার কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষাও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে জলবায়ু পরিবর্তনে সাপের কামড়ের সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ডব্লিউএইচও দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ কিছু কৃষি সম্প্রদায়ের আবাসস্থলকে বিষাক্ত সাপের জন্য জীববৈচিত্র্যের হটস্পট হিসেবে বর্ণনা করেছে। যে কারণে গত বছর থেকে সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের কামড় রোধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
২০০৭ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়া এবং পাকিস্তানে সাপের কামড়ের অপর্যাপ্ত তথ্যের কারণে ডব্লিউএইচও ২০১৭ সালে তার অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের তালিকায় সাপের কামড়ের বিষ যুক্ত করেছে।
নেপালের সরকারি স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের কাছেও সাপের কামড়ে মৃত্যুর সরকারি তথ্য নেই। তবে নেপালে ডাক্তারদের দ্বারা পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সেখানে প্রতি বছর ৪০ হাজার লোককে সাপে কামড়ায় যাদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার মানুষ মারা যায়।
ডব্লিউএইচও এর অনুমান, ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ৩৩ হাজার সাপের কামড়ে ৪০০ জন মারা গেছে।
তবে দক্ষিণ এশিয়ায় সাপের কামড় নিয়ে গবেষণার অভাবের কারণে এই সংখ্যাগুলো তুলনামূলকভাবে কম রিপোর্ট করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের হার্ভার্ড অ্যাফিলিয়েটেড ইমার্জেন্সি মেডিসিন রেসিডেন্সি এবং ব্রিঘাম অ্যান্ড উইমেনস হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রমাহ মেমন বলেন, ‘সাপের কামড়ের ঘটনা কম রিপোর্ট করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন এটি তেমন গুরুতর কোনো সমস্যা নয়।’
আবার কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুসারে, শ্রীলঙ্কায় সাপের কামড় এরই মধ্যে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে বার্ষিক সাপের কামড়ের সংখ্যা ৩১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
পাকিস্তান ও ভারতের সাপের প্রজাতির মধ্যে রয়েছে বিগ ফোর, কিং কোবরা, ব্যান্ডেড এবং কমন ক্রেইটস, গ্রিন পিট ভাইপার, চেকারড কিলব্যাকস, নেপাল কুকরি সাপ এবং রাসেলস ভাইপার। শ্রীলঙ্কায় রাসেলের ভাইপার, সাধারণ ক্রাইট এবং ভারতীয় পাইথনও পাওয়া যায়।
প্রতি বছর ৫৫ লাখ সাপের কামড়ের মধ্যে ১৮ লাখ থেকে ২৭ লাখ কামড়ই হয় বিষাক্ত সাপের কামড়।
ভারতীয় কোবরার কামড়ে নিউরোটক্সিক বিষ থাকে। ডোরাকাটা সাপের কামড় শ্বাসকষ্ট এবং হৃদরোগের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য সাপ যেমন রাসেলের ভাইপার এবং করাত-স্কেলড ভাইপার, ভাস্কুলোটক্সিক বিষ নির্গত করে, যা নেক্রোসিস এবং এমনকি কিডনি ব্যর্থতার কারণ হতে পারে।
সাপের কামড় কোনো তুচ্ছ আঘাত নয়, এটি ভয়ংকর হতে পারে। সাপের কামড়ে মৃত্যুসহ শ্বাসকষ্ট, চোখ খুলতে না পারা এবং কার্ডিয়াক সমস্যা হতে পারে। কিছু সাপ যেমন ভারতীয় কোবরা মানুষের শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। যদি চিকিৎসা না করা হয় বা খুব দেরিতে চিকিৎসা করা হয় তাহলে বিষধর সাপের কামড়ের কারণে পক্ষাঘাত, শ্বাসকষ্ট, রক্তপাতের সমস্যা, কিডনি ব্যর্থতা এবং এমনকি স্থায়ী অক্ষমতা হতে পারে।
উত্তর ভারতের উত্তরাখণ্ড এলাকার একজন বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী এবং সংরক্ষণবাদী জিগনাসু ডলিয়া ব্যাখ্যা করেছেন যে, সমস্ত সাপের কামড়ের ফলে বিষক্রিয়া হয় না। তবে কাউকে সাপে কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার জন্য নেয়া উচিত। নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সমস্ত সাপের কামড়কে বিষাক্ত হিসাবে বিবেচনা করা উচিত।
যে কোনো বিষধর সাপ কাটার পর অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ জরুরি হয়ে যায়। অ্যান্টিভেনম সাপের বিষের দুধ দিয়ে উৎপাদিত একটি প্রতিষেধক যা সাপের কামড়ে হওয়া বিষক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হয় সাপ থেকে বিষ আহরণ করে এবং প্রতিষেধক হিসেবে পরিমার্জিত করার জন্য অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান এবং খাদ্যাভ্যাসের তারতম্যের কারণে এটি ততটা কার্যকর নাও হতে পারে।
২০০০সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গ্রামীণ সিন্ধুর ৪৪.৫ শতাংশ মানুষই অ্যান্টিভেনম সম্পর্কে অবগত না। যার ফলে সাপের কামড় এবং চিকিৎসার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিলম্ব ঘটে। যে কারণে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে অ্যান্টিভেনম উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে এটিকে আরও সাশ্রয়ী করা উচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিদিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রতিটি ডিগ্রি সেলসিয়াসের জন্য সাপের কামড়ের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা কিছু প্রজাতির সাপের আবাসস্থলকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলতে পারে, যার ফলে তারা মানুষের আবাসস্থলের দিকে চলে যায়। যে কারণে মানুষ এবং সাপের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া তৈরির সম্ভাবনা উদ্বেগজনক অবস্থানে চলে যেতে পারে।
একই সঙ্গে শহুরে অবকাঠামো নির্মাণও সাপের এলাকা দখল করে। জলবায়ু প্ররোচিত আবাসস্থলের ক্ষতি সাপের অনিয়মিত আচরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সাপের কামড়ে মানুষের আহত হওয়া এবং প্রাণনাশের ঘটনা।
তবে সাপ খাদ্য শৃঙ্খল এবং বাস্তুতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা খাদ্যশৃঙ্খলের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। তাই অস্বাভাবিকভাবে সাপ মারা হলে খাদ্যশৃঙ্খল এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।
তাই সাপের কামড় রোধে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অ্যান্টিভেনমের উৎপাদন বাড়ানো এবং এটিকে আরো সাশ্রয়ী করে তোলা। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় রেফ্রিজারেশনের প্রয়োজন নেই এমন অ্যান্টিভেনম উৎপাদন করাও বিশেষভাবে জরুরি।