ডিজিটাল অপরাধ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং আইন

টিবিটি ডেস্ক
রাশেদ মেহেদী
প্রকাশিত: ৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৫৮ পিএম
রাশেদ মেহেদী

যে আইন নিয়ে কথা হচ্ছে তার মূল বিষয় হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাই সবার আগে বুঝতে হবে ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিরাপত্তা বলতে কি বোঝায় এবং বর্তমানে এই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ কি? ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অনলাইন ব্যবস্থায় সাইবার হামলা এবং হামলাকারীকে সনাক্ত করা। ডিজিটাল মাধ্যমে থাকা বৃহৎ সার্ভার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত ব্যবহারের ডিভিাইসগুলোর ভেতরে তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া।


এ কারনে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটা কঠোর আইনের আগেও অনেক বেশী জরুরী আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ডিজিটাল অপরাধী সনাক্ত করার সক্ষমতা নিশ্চিত করা। সক্ষমতার ঘাটতি আছে বলেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার হামলায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় অপরাধীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ব্রাম্মনবাড়িয়ার ঘটনায় নিরপরাধ রাসরাজ দাশ জেল খেটেছেন কিন্ত তার আইডি হ্যাক করা মূল অপরাধীদের ধরা যায়নি। অনেকে প্রকৃত অপরাধীকে সনাক্ত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতার চেয়ে সদিচ্ছার অভাবের অভিযোগও করতে পারেন। কিন্তু যুক্তি-তর্কের জটিলতায় না গিয়ে যদি নিতান্তই সরল সাদা চোখে দেখি তাহলে সাধারনভাবে সক্ষমতার অভাবের কথাই বলতে হবে। কিন্তু সক্ষমতার অভাব দেখিয়ে যদি বার বার রসরাজ দাশরাই জেলে যান আর প্রকৃত অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তাহলে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করার বিকল্প থাকে না। 



 সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চেহারাটা অপরাধ দমনে সদিচ্ছার অভাবকেই জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কত বড় অন্তরায় হতে পারে, মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কতটা বিপদজনক সে সম্পর্কে সম্পাদক পরিষদ, নাগরিক সমাজ বিস্তারিতভাবে ব্যাখা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ও এই আইন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ আলোচনায় সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আর একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। এ আইনের আরও কয়েকটি ধারা আলোচনায় আসা উচিত। বিশেষ করে সেইসব ধারা যার মাধ্যমে ডিজিটাল অপরাধ উৎসাহিত হবে। 


প্রথমে আসি আইনের ৩০ ধারায়। এই ধারা অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে আইন বহির্ভূতভাবে আর্থিক লেনদেনের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড কিংবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এখন এই ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে ৮০০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের জন্য দায়ীরা সনাক্ত হলেও তাদের শাস্তি কিন্তু সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে খালাস? এই আইনের সমর্থকরা বলতে পারেন বাংলাদেশ ব্যাংকে সংঘটিত অপরাধ ডিজিটাল জালিয়াতি এবং ২২, ২৩ ও ২৪ ধারা অনুযায়ী তার বিচার হবে। এই দু’টি ধারায় ডিজিটাল জালিয়াতি ও প্রতারণার জন্য বিচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ তিনটি ধারাতেও প্রথমবার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের জেল বা পাঁচ লাখ টাকা কারাদন্ড। এবার এই আইন প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত অতি বুদ্ধিমান কর্তা-ব্যক্তি বলতে পারেন, আরে ভাই আপনি আইন পড়ে দেখেন, এখানে সাইবার স্পেসে হ্যাকিং এর অপরাধারে জন্য পৃথক ধারা আছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘটনা হ্যাকিং এবং এর শাস্তি হবে ৩৪ ধারা অনুযায়ী, এখানে কিন্তু ১৪ বছরের জেল এবং এক কোটি টাকা দন্ডের বিধান! তারা আরও জোর দিয়ে বলতে পারেন ধারা ২৭ দেখেন, এখানে সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ১৪ বছরের জেলের বিধান আছে! কিন্তু ২৭ এবং ৩৪ ধারায় যে সংজ্ঞা আছে তা ডিজিটাল মাধ্যমের অর্থ চোরদের ধরার জন্য প্রযোজ্য হবে না, এটা প্রমাণ করতে খুব বেশী ঝানু উকিলেরও দরকার হবে না, শিক্ষানবীশ আইনজীবীও সেটা সহজেই প্রমাণ করতে পারবেন। কারন ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে হ্যাকিং অর্থ কম্পিউটার মাধ্যমে প্রবেশ করে তথ্য বিনাশ, বাতিল কিংবা তার ক্ষতিসাধন। আর ২৭ ধারায় সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সংজ্ঞার ভেতরে যেসব শব্দ আছেও হ্যাকিং এর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দের অতিরিক্ত পরিশব্দ মাত্র। অতএব ডিজিটাল আর্থিক জালিয়াতি করলে ওই পাঁচ বছর আর পাঁচ লাখ টাকা! অতএব আশংকা করাই যায় এই আইন ডিজিটাল মাধ্যমে আর্থিক জালিয়াতিকে কিঞ্চিৎ উৎসাহিত করতেই পারে! 


২৭ ধারার সংজ্ঞায় কম্পিউটার মাধ্যমে ম্যালওয়ার প্রবেশ করানোর ফলে ‘কারও যদি মৃত্যুর ঘটনা কিংবা গুরুতর জখম হওয়ার’ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে! এখন পর্যন্ত দুনিয়াতে ম্যালওয়ার তথ্য চুরির কাজেই ব্যবহৃত হয় জেনে এসেছি। আর্থিক লেনদেনের তথ্য চুরি করে ব্যাংক একাউন্ট জালিয়াতিতেও ম্যালওয়ারের ব্যবহারের কথা অনেকবার শোনা গেছে। কিন্তু ম্যালওয়ার কম্পিউটারে ঢুকিয়ে রক্ত-মংসের ব্যক্তিকে হত্যা কিংবা গুরুতর জখম করার মত ঘটনা আদৌ সম্ভব কি’না তা নিয়ে সাইবার দুনিয়ার বড় বড় দিকপালরাও এখন পর্যন্ত আশংকা কিংবা উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। তবে আমাদের ডিজিটাল আইন প্রণেতারা অনেক বেশী দূরদর্শী কিংবা অতি রোমান্টিক বলতেই হবে। তথ্য চুরি, অর্থ চুরি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারা আরও দূরে অচেনা ভবিষ্যতের দিকে চোখ দেখছেন! পায়ের তলায় চোরবালিতে হারিয়ে যাওয়ার ভয় কে জয় করতে তারা দিনের আকাশে লক্ষ তারা গোনার কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন! 


যা হোক চুরি জালিয়াতির বিপরীতে এই আইনের ৩১ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যমে গালি দেওয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর আর ৩২ ধারায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহকে অনায়াসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী অপরাধ গণ্য করে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে...! অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এ কারনে বললাম যে সরকারি গোপনীয় তথ্য বেশীরভাগ সময়ই অনুসন্ধানী সাংবাদিককে সংগ্রহ করতে হয় জনস্বার্থে কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে প্রতিবেদন তৈরির জন্যই। এখন তো সরকারি সব ফাইলেই গোপনীয় লেখা হয়। মন্ত্রণালয়ের পিআরও সাহেবের প্রেস রিলিজের ফাইলের উপরও লেখা থাকে ‘অতি গোপনীয়’। অতএব এজাতীয় ‘মহা গোপনীয়’ ফাইলের তথ্য পাওয়া এখনতো পরিকল্পিত খুনের মতই ভয়ংকর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে! 


অনেক ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমেই আমলাদের দূর্নীতিম রাষ্ট্রের অনেক বড় আর্থিক ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ৩২ ধারা সেই পথ একবারে বন্ধ করে দেবে। কারন এ ধারায় ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী অপরাধের শাস্তি ১৪ বছরের জেল। বুঝতেই পারছেন ঔপনিবেশিক যুগের অন্ধকারের ভূত কে দিয়ে ডিজিটাল আলো জ্বালানোর চেষ্টা এই ৩২ ধারা! আর এ চেষ্টায় সবচেয়ে বেশী সুখী বোধ করছেন দূর্নীতিবাজরা। প্রকল্প দূর্নীতির কোন তথ্য আর ই-মেইলে, হোয়াট অ্যাপে চট করেই সাংবাদিকের কাছে যাবে না! তারপরও যদি বেয়ারা সাংবাদিক অন্য কোনভাবে দূর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেই ফেলে তাহলে ৩১ ধারায় বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার জন্য প্রথমেই গ্রেফতার করে জেলে নেওয়া যাবে। ব্যাটা সাংবাদিক কোর্ট-কাচারি করে তথ্য সত্য প্রমাণ করতে করতে কয়েক মাস জেল খাটা সারা! এ আইনের ৪৩ ধারায় পুলিশকে যে কোন নাগরিককে বিনা অপরাধে কেবল সন্তেহের বশে গ্রেফতারের অকল্পনীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত, দুনিয়ার অন্য কোন দেশের আইনে এ ধরনের বিপদজনক ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয় এ আইনের ৫৭ ধারায় ভুক্তভোগী নাগরিককে বিনা অপরাধে হয়রানির শিকার হওয়ার জন্য বিচার চাওয়ার পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 


সার্বিকভাবে খুব মনযোগ দিয়ে এ আইনটি পড়লে এটা পরিস্কার হয়ে যায়, এ আইনটি প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল অপরাধ দমন নয়, বরং ডিজিটাল গালি প্রতিরোধের আইন। আর এই আইনের মাধ্যমে ডিজিটাল জালিয়াত এবং দূর্নীতিবাজদের সুরক্ষার আইনী ফাঁক রাখর ব্যবস্থা করেছেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চিন্তা-চেতনার আমলারা। এই আইন প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাইকে গালি দিলে মাত্র কয়েক শ’ মানুষ বড় জোর শুনতে পারে। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার হলে তা কোটি কোটি মানুষ শোনে, অতএব ডিজিটাল গালির জন্য শাস্তি বেশীই হওয়া উচিত। মেনে নিলাম তাদের বক্তব্য, কিন্তু নিতান্তই অস্পষ্ট সংজ্ঞার এই আইনে তো গঠনমূলক সমালোচনাকেও গালি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে! তাহলে যে কোন ধরনের সমালোচনার পথই কি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে না? সমালোচনা ছাড়া কি গণতন্ত্র হয়? গতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি গালির শাস্তি কি চুরি, জালিয়াতির চেয়ে বেশী হতে পারে?  


এর আগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপ্রয়োগের ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। প্রত্যাশা ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার আগে এ আইন প্রণয়নের সময় অপপ্রয়োগ ঠেকানোর একটি বিধান অবশ্যই সংযোজিত হবে। সেটাও নেই। দু:খিত, যুক্তির বিচারে এবং সুস্থ বিবেচনায় এ আইনটিকে ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য কার্যকর ও জনস্বার্থ রক্ষার আইন হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না।   

রাশেদ মেহেদী, বিশেষ প্রতিনিধি, সমকাল