বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার আসিয়ান

টিবিটি ডেস্ক
টিবিটি রিপোর্ট
প্রকাশিত: ২৭ মার্চ ২০২৪ ০১:৩৫ এএম

বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। রফতানি যৎসামান্য হলেও দেশে মোট পণ্য আমদানির ২৬ শতাংশই হয় চীন থেকে। তবে জোট হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসভুক্ত (আসিয়ান) দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের আকার এখন ক্রমেই বড় হচ্ছে। 

বর্তমানে দেশের মোট আমদানি বাণিজ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের এ জোটের অবদান ১৬ শতাংশের বেশি। রফতানি আয়ের উৎস হিসেবে দেশগুলো এখনো তেমন একটা অবদান রাখতে না পারলেও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে সামনের দিনগুলোয় তা সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। এর মধ্যে মূলত পাঁচ দেশের সঙ্গে (ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড) উল্লেখযোগ্য হারে বাণিজ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এর বাইরে প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক থাকলেও দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে তা এখন একপ্রকার বন্ধ রয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো থেকে মোট ১ হাজার ১৩৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দেশগুলোয় পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৭৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। 

এ হিসেবে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ১ হাজার ২১১ কোটি ৮ লাখ ডলার। আমদানি ও রফতানি বাবদ প্রাপ্ত আয়ের পরিসংখ্যান বিবেচনায় একক দেশ হিসেবে বর্তমানে এর চেয়ে বেশি বাণিজ্য হচ্ছে কেবল চীনের সঙ্গে। 

সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৮২ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। আর পণ্য রফতানির অর্থমূল্য ৬৮ কোটি ডলার। চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক চুল্লি, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, তুলা, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সাউন্ড রেকর্ডার ও রিপ্রডিউসার, বোনা কাপড়, কৃত্রিম তন্তু ইত্যাদি। দেশটিতে রফতানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওভেন পোশাক, নিটওয়্যার, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা ইত্যাদি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে আসিয়ানভুক্ত কয়েকটি দেশ বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আয়তনে বৃহৎ এ অঞ্চলটি বাজার হিসেবেও বিশাল। ফলে দ্য রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) মাধ্যমে বড় একটি অর্থনৈতিক পাওয়ার ব্লক হিসেবে উত্থান ঘটেছে আসিয়ানের। 

সেদিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে জোটটির বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও আন্তঃযোগাযোগ এখনো তেমন শক্তিশালী না। বর্তমানে বিমসটেকের (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) মাধ্যমে আসিয়ানের দুটি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) আলোচনা চলছে। জোটটি আয়োজিত পরবর্তী সম্মেলনে এর স্বাক্ষর হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই বাজারে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‌এটা ঠিক যে মিয়ানমারের বর্তমান ভূরাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগগুলোকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মধ্যমেয়াদিভাবে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে আসিয়ানের একটা বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। বিমসটেক এফটিএর মাধ্যমে যদি একটা ফুটপ্রিন্ট আমরা আসিয়ান মার্কেটে পাই—কারণ বিমসটেকের দুটি দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার আসিয়ানেরও সদস্য—তাহলে আসিয়ান এফটিএ ও আরসিইপির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে পারব। এতে করে যদি আমরা যোগাযোগ, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে সংশ্লেষ করতে পারি তাহলে বাংলাদেশ শুধু আসিয়ান থেকে আমদানিই করবে না, ওই মার্কেটে রফতানিরও একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এটা আরো প্রয়োজন, কারণ আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হচ্ছে। ফলে পণ্য ও বাজারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। সেদিক থেকেও এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’

আসিয়ানের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর। দেশগুলো থেকে বেশি আসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল। যেমন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশ মূলত ভোজ্যতেল আমদানি করে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। আবার সিঙ্গাপুর থেকে খনিজ পণ্য আমদানি করলেও বাংলাদেশ থেকে খুবই সামান্য পরিমাণে তৈরি পোশাক যায়। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘‌আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশে রফতানি করে। এসব দেশের মধ্যে আছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। এসব দেশ থেকে বেশি আনা হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বা শিল্পের কাঁচামাল। আমরা যদি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে চিন্তা করি তাহলে অনেক বেশি বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।

 কেননা এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব হারানোর বিষয় রয়েছে। আবার যদি শুধু পোশাক পণ্যের ওপর নির্ভর করে দেশগুলোয় রফতানি বাড়াতে চাই তাহলেও আমাদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং হবে। আসিয়ান দেশগুলোয় রফতানি বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগাতে অবশ্যই পণ্য বৈচিত্র্যকরণ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু পোশাকনির্ভর হলে হবে না। 

কারণ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় পোশাক পণ্যে সুরক্ষা দেয়া আছে। আবার পোশাকের জন্য সিঙ্গাপুরের বাজার তেমন বড় নয়। চীন নিজেই পোশাকের বড় সরবরাহকারী। তাই তারা আমদানি তেমন করবে না। ফলে আসিয়ানের বাজারে রফতানির জন্য পোশাকবহির্ভূত পণ্য নিয়ে মনোযোগী হতে হবে।’

আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অনেক দিন ধরেই সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কেননা দেশগুলো থেকে সহজেই জ্বালানি আমদানির সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি আসিয়ানে জোটবদ্ধ হতে পারলে কৃষি, ওষুধসহ নানা খাতের পণ্য রফতানিই সম্ভব হবে।