আর্থিক সংকটে সাবলেট দেওয়া নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে

টিবিটি ডেস্ক
টিবিটি রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৩০ মার্চ ২০২৪ ০২:২৮ এএম

বাড়িভাড়াসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বয় করে টিকে থাকতে গিয়ে মানুষের স্বাভাবিক বসবাস বিঘ্নিত হচ্ছে। বাধ্য হয়ে মানুষ বাসস্থান ভাগ করে নিচ্ছেন। আর এ কারণে দেশে সাবলেট ভাড়াটিয়া পরিবারের (খানা) সংখ্যা বেড়েছে। শহর ও গ্রামে সাবলেট দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নতুন জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে খানার (পরিবার) বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে মাঠপর্যায় থেকে সাবলেটের এ তথ্য তুলে আনা হয়েছে।

স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম (এসভিআরএস) প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, বর্তমানে দ্রব্যমূল্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বাড়ি ভাড়াও। তবে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে যারা একক বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তারা সাবলেট দিচ্ছেন। কেউ কেউ একক বাসা ছেড়ে দিয়ে সাবলেটে উঠছেন। এক্ষেত্রে আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ এমন কাজ করছেন। 

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গ্রামে সাবলেট বেড়ে যাওয়ার কারণ-গ্রামেও এখন বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংকের শাখা, স্কুল বা কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। এগুলোতে যারা চাকরি করেন তাদের অধিকাংশই ভাড়া থাকেন। ভাড়া দেওয়ার জন্য শহরের মতো আলাদাভাবে বাড়ি গ্রামে সাধারণত কেউ করেন না। তবে নিজের থাকার বাড়িতেই সাবলেট ভাড়া দিয়ে থাকেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে গেছে।

উদাহরণ দিতে গিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, শরীয়তপুর ফিল্ড ভিজিটের সময় দেখেছি-প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক বাড়িতে সাবলেট ভাড়াটিয়া আছেন। কারণ মানুষগুলো পদ্মার বিভিন্ন চরের। নদীভাঙা কিংবা অন্য কোনো কারণে তারা এসব বাড়িতে পরিবার নিয়ে সাবলেট ভাড়া থাকেন। কিন্তু চর জাগলে তারা সেখানে গিয়ে থাকেন ও চাষাবাদ করেন।

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সাবলেট বাসাভাড়া গ্রহণকারী পরিবারের সংখ্যা ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। সেটি বেড়ে ২০২২ সালে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হয়। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সাবলেট ভাড়া প্রদানকারী পরিবারও বেড়েছে। ২০২১ সালে এ হার ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। এ অবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমেছে একক খানায় (পরিবার) বসবাসকারীর সংখ্যা। ২০২১ সালে এ হার ছিল ৯৭ দশমিক ১ শতাংশ, পরের বছর সেটি কমে হয় ৯৬ শতাংশ, ২০২৩ সালে আরও কমে হয়েছে ৯৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরি বলেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়েছে। ফলে মানুষের স্থানান্তরও বেড়ে গেছে। অর্থাৎ শহর থেকে টিকতে না পেরে অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। আবার গ্রাম থেকে অনেক পরিবার শহরে আসছে। আঞ্চলিক স্থানান্তরও বেড়েছে। এসব পরিবার সাবলেট বাসা ভাড়া নিতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় অনেকে বড় বাসা ছেড়ে সাবলেটে চলে যাচ্ছে। 

অর্থনৈতিক সংকটের নেতিবাচক প্রভাব জীবনযাত্রার মানের ওপর পড়ছে। এমন পরিস্থিতি স্বল্প ও নিু আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। গ্রামে বা পল্লী অঞ্চলে সাবলেট ভাড়াটিয়া পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১ সালের হিসাবে এ হার ছিল ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ, ২০২২ সালে বেড়ে হয় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে সেটি আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অনুসারে, দেশে খানাগুলোর মধ্যে সাবলেট দেওয়া ও নেওয়ার প্রবণতা তিন বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশে সাবলেট গ্রহণকারী খানার সংখ্যা ৪ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; ২০২১ সালে যা ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ। অর্থাৎ এই তিন বছরে সাবলেট গ্রহণকারী খানার সংখ্যা ১ দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে।

সাবলেট নেওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সাবলেট দেওয়া খানার সংখ্যাও বেড়েছে। বিবিএসের ওই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সাবলেট দেওয়া খানার সংখ্যা ছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ; ২০২৩ সালে তা শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। একক বাড়িতে বসবাসকারী খানার সংখ্যা ২০২১ সালে ছিল ৯৭ দশমিক ১ শতাংশ; ২০২৩ সালে তা ৯৫ শতাংশে নেমে এসেছে। 

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান  বলেন, ‘মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছেন, সে কারণে তাঁরা নানাভাবে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। যাঁরা এককভাবে বাসা নিতে চান, তাঁরা হয়তো নিতে পারছেন না। আর যাঁরা বাসা ভাড়া নিয়েছেন, তাঁরাও হয়তো সব ব্যয় কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে।’