আপনি হয়তো দেখবেন না

টিবিটি ডেস্ক
খন্দকার আতিক
প্রকাশিত: ৬ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৩৩ এএম

এখন ফেসবুকের দুনিয়া। অনলাইন। সবকিছুই অন। এমনকি গোপনীয় প্রেমও এখন ওপেন,অন। কিশোর কিশোরীরা তাদের প্রেমের ছলাকলার রিয়্যাকশন ফেসবুকের মাধ্যমে আকাশে ছড়িয়ে দেয়। সেই রানারের হাত থেকে পাওয়া চিঠির মতো গোপন প্রেমের যুগ এখন আর নেই।

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখে তারায় তারায় রটিয়ে দিতে না চাইলে আছে নানান ওয়ান টু ওয়ান অপশন। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি কত কি। মন চাইলে মন পাবে, দেহ চাইলে দেহ, সবই হবে গোপনে জানবে না কেহ।

এখন মানুষ ফেসবুকে কত কি পোস্ট করে, আপনি দেখেন কিনা আমি জানিনা। মানুষ খালি গায়ে তাদের পুকুরে পুঁটি মাছ ধরতে জাল ফেলে তার ছবি দেয়ালে সেঁটে দেয়। অনেকে আছে যখন পোস্ট করার কিছু খুঁজে না পায় তখন কয়েকটা ফ্রেস ইডিয়াম ইংরেজি গ্রামার বই থেকে তুলে দেয়। কিছু একটা দিতেই হবে। না দিলে মনে হয় জীবন অশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  নানান মানুষ নানান উদ্দেশ্যে নানান কিছু পোস্ট দেয়। আমিও সতত একটা উদ্দেশ্য মাথায় রেখে পোস্ট দেই।  উদ্দেশ্য যদি আপনি দেখেন!  সব পোস্ট আপনাকে দেখানো উদ্দেশ্য না কিন্তু মনে মনে আশা পোষণ করি, যে পোস্টটা আপনাকে দেখাতে চাই ওটা যেন আপনার নজরে পরে।

খুলনার রূপসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি আমি। গ্রাম থেকে এই প্রথম আমি শহরে। সবই কেমন নতুন লাগে। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে হাইস্কুল যুক্ত থাকায় এর নাম রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলের তিনটা/চারটা গেট থাকায় বহুমুখী বলতে আমার কাছে গেটের প্রসঙ্গটা বার বার মাথায় আসতো। একটা গেটের সাথে বাউন্ডারির ভেতরে একটা বড়ই গাছ ছিল। এত বড় শহরে বড়ই পারতে কেউ বাধা দেয় না, এটা বেশ ভালো লাগতো। 

স্কুলের টিচার কমনরুমে একটা রঙিন টেলিভিশনে মাঝে মাঝে কার্টুন দেখার স্মৃতি এখনো মধুর মনে হয়। যদিও মন ভরে সেটা দেখার সুযোগ পেতাম না। তখন রূপসা নদীতে ব্রিজ হয়নি। ফেরিতে মানুষ পারাপার হতো। নদীর এপার থেকে ওপারে যেতে একজনের পঁচিশ পয়সা লাগতো। এই পঁচিশ পয়সা যেখান দিয়ে আদায় করতো ঐ জায়গা ছাড়াও নানান জায়গা দিয়ে মানুষ ফেরিতে পৌঁছাতে পারতো। তখন মানুষের টাকা পয়সার প্রতি ব্যবসায়ীদের মতো এত লোভ ছিল না মনে হয়, ফেরিতে পয়সা আদায়ে তেমন কড়াকড়ি ছিল না হয়তো। আমি বয়সে ছোট থাকায় ঐ পঁচিশ পয়সা আমার কাছে চাইতে না। তাই বিনা পয়সায় বারবার ফেরি পার হতাম। 

একা একা এই সুযোগ নিতে ভালো লাগছিল না। এরকম সময়ে বাসার পাশে সমবয়সী একজনের সাথে ভাব হতে শুরু করলো। স্কুল ফাঁকি দেয়ার প্রতি তার যতটুকু মনোযোগ, ঘোরাঘুরিতে ইবনে বতুতার চেয়ে একটু বেশি মনে হয়। তিনি পুরো দস্তুর শহুরে। আমি গ্রাম্য ভাবটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবু তার সাথে সখ্যতা জমে উঠতেছে পঁচিশ পয়সায় একটা খিরা কিনে ভাগ করে খেয়ে আবার পঁচিশ পয়সা দিয়ে আরেকটা কিনে খাওয়ার মধ্যে দিয়ে। তার আপাদমস্তকে শহুরে আচারণ বিদ্যমান। এই গলি দিয়ে ঢুকে ঐ গেট দিয়ে বের হয়ে আসে। কেমনে কি, একদম পানতা ভাতে ঘি এর মতো অবস্থা। 

তখন রূপসা থেকে বাগেরহাট এই দিকে ট্রেন চলতো।  এখনো হয়তো চলে। একদিন শহুরে বন্ধুর সাথে পঁচিশ পয়সার ফেরি ফ্রি’তে পার হয়ে ‘জার্নি বাই ট্রেন’ শুরু করলাম। ট্রেনের টিটিরও বোধহয় অভাব কম ছিল অথবা আমরা সাইজে ছোট ছিলাম। তাই ভাড়া চাওয়া আর দেয়া দু'পক্ষেরই তাড়া কম অনুভূত হলো। ট্রেন সোনার বাংলা সুবর্ণ’র মতো ডাইরেক্ট একশন না। তাই ঘাটে ঘাটে ঘাট ধরে। ট্রেন যখন ঘাট ধরার জন্য থামার হুইসেল দেয় তখন আমার বন্ধু ট্রেন থেকে নেমে যায়। আবার যখন চলার বাঁশি দেয় তখন বন্ধু লাভ দিয়ে উঠে পরে। শহরে বন্ধুর নানা কারিশমায় আমি ইতিমধ্যেই মুগ্ধ। তার ওপর এই ওঠা নামায় যারপরনাই মুগ্ধতা ট্রেনের গতির মতো ছড়িয়ে পড়লো। 

পরস্ত্রী ছাড়া মুগ্ধতা কোন দোষের না। শহরে বন্ধুর “ওঠানামা” গুন আমার মনকে মুগ্ধ করে সংক্রামক ব্যাধির মতো আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। আমিও “ওঠানামা” করতে প্রবৃত্ত হলাম। এখানে আগে ‘ওঠা’ পরে ‘নামা’ এরকম নয়। আগে নেমে পরে ট্রেন ছাড়ার সময় লাফ দিয়ে উঠতে হয়। বন্ধু তাই করে। আমিও বন্ধুকে অনুসরণ করে আগে নামলাম।

যখন ট্রেন ছাড়ার জন্য হুইসেল দিলো আমিও লাফ দিয়ে উঠতে যেয়ে প্রথম পা’টা ট্রেনের সিঁড়িতে দিলে পা’টা ছুটে যায়। ট্রেন চলতেছে। কেউ একজন আমার ডান হাতের ড্যানা ধরে ঝুলিয়ে আমাকে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন।

ঘটনাটা স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

তখন বুঝিনি। 

কি ঘটতে চলেছিল। 

যখন বুঝেছি তখন রেলের চাকায় বুকের হাড্ডি ভাঙ্গার আতঙ্কে আতকে উঠেছি। বেঁচে থাকার রণাঙ্গনে যখন ঐ ‘হাড্ডি ভাঙ্গার’ আওয়াজ পাই তখন সেই অজানা  অপরিচিত ব্যক্তি যিনি ড্যানা ধরে ঝুলিয়ে দরজা দিয়ে রেলের ভেতরে ঢুকিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে আসে। 

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আপনাকে খুঁজে বের করা কি সম্ভব! আপনার কোন মোবাইল নাম্বার! ফেসবুকে লিমিট করা পাঁচ হাজার বন্ধুর সবাইকে আমি চিনি না। মাত্র কয়েকজনকে চিনি। অপরিচিত কিন্তু লিমিট পাঁচ হাজারের ভেতরে কি আপনি আছেন! ফেসবুকে আমার পোস্ট করা সব পোস্ট কি আপনি দেখেন? সব দেখার দরকার নেই, যেই পোস্ট টা আপনাকে উদ্দেশ্য করে দেয়া সেটা কি আপনার নজরে পরে? 

আমি জানি 

এটা সম্ভব না।

 না আপনি আমাকে চিনেন! 

না আমি।

আমার দ্বারা আপনাকে চিনে বা খুঁজে বের করা সম্ভব না। তবু প্রতিটি মূহুর্ত সেই অচেনা অজানা “আপনার” প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নত হয়ে থাকে। আমার নামাজ শেষের সকল প্রার্থনায় আপনি থাকেন। নিয়মিত এবং ধারাবাহিক ভাবে।

ফেসবুকের দুনিয়ায় কৃতজ্ঞতা আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতির মাধ্যমে আপনার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা।

হয়তো বৃথা চেষ্টা।

তবু প্রকৃতির একটা একশন তো থাকে।

আমি প্রকৃতির মাধ্যমে আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

 এই লেখা আপনি হয়তো দেখবেন না।

সেটা সম্ভব না।

তবুও চেষ্টা করছি।

খন্দকার আতিক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক